রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর
Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer : রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer নিচে দেওয়া হলো। এই West Bengal WBCHSE Class 11th History Rastrer Prokriti Question and Answer, Suggestion, Notes | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – থেকে রোচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর (Descriptive Question and Answer) গুলি আগামী West Bengal Class 11th Eleven XI History Examination – পশ্চিমবঙ্গ একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার জন্য খুব ইম্পর্টেন্ট। একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষা তে এই সাজেশন বা কোশ্চেন (রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer) গুলো আসার সম্ভাবনা খুব বেশি।
তোমরা যারা রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer খুঁজে চলেছ, তারা নিচে দেওয়া বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর গুলো ভালো করে পড়তে পারো।
রাজ্য (State) | পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) |
বোর্ড (Board) | WBCHSE, West Bengal |
শ্রেণী (Class) | একাদশ শ্রেণী (WB Class 11th) |
বিষয় (Subject) | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস (Class 11 History) |
অধ্যায় (Chapter) | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (Rastrer Prokriti) |
[একাদশ শ্রেণীর সমস্ত বিষয়ের প্রশ্নউত্তর Click Here]
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | West Bengal WBCHSE Class 11th History Rastrer Prokriti Question and Answer
বিশ্লেষণধর্মী | রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | WB Class 11 History Rastrer Prokriti Short Question and Answer :
1. কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজার প্রধান কর্তব্য সম্পর্কে যেসকল পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
Ans: অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত রাজার প্রধান কর্তব্যসমূহ
রাজার প্রধান কর্তব্যগুলি সম্পর্কে কৌটিল্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উল্লেখ করেছেন-
(i) শাসন সংকান্ত কর্তব্য: একজন রাজার শাসন সংক্রান্ত কর্তব্যকর্মের উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে রাজা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক শান্তিবিঘ্নকারী দুষ্কৃতিদেরও দমন করবেন।
(ii) মন্ত্রী-অমাত্যবর্গের নিয়োগ সংক্রান্ত কর্তব্য: রাজার অপর প্রধান কর্তব্য হল মন্ত্রী-অমাত্য ও অন্যান্য পদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করা। কৌটিল্যের মতে, রাজা তাঁর মন্ত্রীর সংখ্যা তিন বা চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন। তাছাড়া মন্ত্রী, অমাত্য ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজা তাদের বাগ্মীতা, দক্ষতা, সদাচার, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, ধৈর্যশীলতা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেবেন।
(iii) প্রজাদের নিরাপত্তা প্রদান: কৌটিল্য রাজার প্রধান কর্তব্যসমূহের আলোচনায় বলেছেন যে, রাজা দেবরাজ ইন্দ্রের মতো প্রজাদের রক্ষা এবং যমরাজের মতো অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করে জনগণের নিরাপত্তা বিধান করবেন।
(iv) জনকল্যাণসাধন: কৌটিল্যের মতে, প্রজাদের যাবতীয় স্বার্থরক্ষা রাজার কর্তব্য এবং তাদের সুখই প্রকৃতপক্ষে রাজার সুখ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। এ ছাড়া রাজা ধনী-দরিদ্রের সামাজিক ব্যবধান দূর করতেও সচেষ্ট হবেন। প্রজাকল্যাণের প্রয়োজনে তাঁর হৃদয় হবে কোমল এবং রাজকোশ থাকবে উন্মুক্ত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কালে রাজা খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান ও শস্যবীজ দান করে প্রজাকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হবেন। এর পাশাপাশি অসমর্থ, বয়স্ক, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা নাগরিকদের সুরক্ষা ও ভরণপোষণ দিতেও রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকবে। আবশ্যিক পণ্যের মজুতদারি, কালোবাজারি, ভেজাল দেওয়া ইত্যাদি কাজে লিপ্ত মানুষদের নিবৃত্ত করার কাজে রাজা কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবেন।
(v) পোরান পকিতি: ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত পোরান পকিতি বা প্রাকৃতিক আইনের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন যে, মৌর্য আমলের বহুপূর্ব থেকেই কিছু প্রচলিত নিয়মকানুন প্রজাদের কল্যাণসাধনে পালিত হত। এই প্রকার বিধিবিধান কোনও শাসকই উপেক্ষা করতে পারতেন না।
(vi) সামাজিক কর্তব্য পালন: রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষা করা রাজার অপর প্রধান কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এ ব্যাপারে রাজা যে নানান প্রশাসনিক সাহায্য নেবেন সেকথাও অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের ভিতর ও বাইরের খবর সংগ্রহ করার জন্য রাজা গুপ্তচর নিয়োগ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়। গুপ্তচর সূত্রে প্রাপ্ত খবরাখবর বিচারবিবেচনার মাধ্যমে রাজা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজদূতগণও গুপ্তচরের কাজ করতেন।
2. কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজার অন্যান্য কর্তব্য সম্পর্কে যেসকল পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
Ans: অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত রাজার অন্যান্য কর্তব্যসমূহ
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে একজন রাজার কিছু প্রধান কর্তব্যের পাশাপাশি আরও অন্যান্য কর্তব্যের কথাও বলা হয়েছে। রাজা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, রাজা নিজের ক্ষমতা জারি করার জন্য বিপক্ষের পরিকল্পনা দমন করবেন। এমনকি কূটনীতি, ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাদের নিয়ন্ত্রণে আনবেন।
(i) শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন: কৌটিল্যের মতে, রাজার প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্ভর করে তার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উপর। সুদক্ষ সেনাবাহিনী গঠনের মাধ্যমে তিনি শত্রুরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান প্রতিহত করতে ও প্রয়োজনে শত্রুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করতে পারেন। অন্যদিকে হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক বাহিনী গঠনের পাশাপাশি সেনাধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যাপারেও রাজা দৃষ্টি রাখবেন। এ ছাড়া প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর তদারকির বিষয়টি রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
(ii) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, রাজা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনিই রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার প্রধান। অর্থশাস্ত্রে আরও বলা হয় যে, দেওয়ানি মামলার বিচার করবেন ‘ধর্মস্থ’ নামক তিনজন মহামাত্র এবং ফৌজদারি মামলার বিচার করবেন ‘প্রদেষ্ট’ নামক তিনজন মহামাত্র। এর পাশাপাশি বলা হয় ‘কণ্টকশোধন’ আদালতে চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা প্রভৃতি মামলার বিচার হবে এবং এই বিচারের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রাজার কাছে আবেদন করা যাবে।
(iii) সরকারি প্রশাসনে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজা নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি প্রশাসনে কর্মচারীদের নিয়োগ করবেন। প্রশাসনের শীর্ষে থাকার কারণে রাজা সামরিক বাহিনীর প্রধান বা সেনানায়কদের নির্বাচন করবেন। তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারকদেরও নিয়োগ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ বা প্রধান পুরোহিত নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজা তার যোগ্যতা যাচাই করবেন বলে অর্থশাস্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
(iv) আর্থিক সচ্ছলতা: কৌটিল্যের মত অনুযায়ী, প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে রাজ্যের আর্থিক সচ্ছলতার উপর। তাই রাজা নানাভাবে আর্থিক উন্নতির প্রচেষ্টা চালাবেন। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য তিনি কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন। রাজকোশ সর্বদা পরিপূর্ণ রেখে জনগণের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করাই হল রাজার অপর গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
(v) জনবসতি স্থাপন: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে জনপদনিবেশ অর্থাৎ নতুন জনবসতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মহামারির ফলে জনবসতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে রাজা সেখানে পুনরায় জনবসতি স্থাপন করবেন। এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল থেকে মানুষদের নিয়ে এসে বসতি গঠন করাও ছিল রাজার কর্তব্য।
(vi) দৈনন্দিন কর্তব্যপালন: অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য রাজার দৈনন্দিন পালিত কর্তব্যকর্মের একটি তালিকা প্রদান করেছেন। এতে বলা হয়, দিন ও রাতের বিভিন্ন সময় রাজা নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করবেন। এই সকল কাজের মধ্যে রাজার খাদ্যগ্রহণ ও বিশ্রামের সময় থাকবে ৭ ঘণ্টা। কৌটিল্যের মতে, রাজা যদি পরিশ্রমী ও সক্রিয় হন তাহলে তাঁর রাজ্যের প্রজা, মন্ত্রীপরিষদ প্রত্যেকেই কর্তব্যনিষ্ঠ হয়। ফলে রাজ্যের সমৃদ্ধি ঘটে।
3. মৌর্য শাসনব্যবস্থার উপাদানরূপে অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব আলোচনা করো।
Ans: মৌর্য শাসনব্যবস্থার উপাদানরূপে অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব
একসময় মনে করা হত, অর্থশাস্ত্র মৌর্য যুগে লেখা একটি গ্রন্থ। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্য বা কৌটিল্য এর রচয়িতা। কিন্তু পরবর্তীকালের গবেষণায় জানা গেছে যে, অর্থশাস্ত্রের সব অংশ মৌর্য যুগের লেখা নয়, অনেক পরের রচনা। কিথ, উইন্টারনিৎজ, জলি প্রমুখ ঐতিহাসিকরা অর্থশাস্ত্রকে কেবলমাত্র মৌর্য যুগের ইতিহাসের উপাদান বলতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে তাঁদের যুক্তিগুলি হল-
- অর্থশাস্ত্র মূলত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের রচনা এবং গ্রন্থটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত যেখানে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের পরিধি ছিল বিশাল।
- এতে চিনা রেশমের উল্লেখ আছে কিন্তু মৌর্য যুগে চিনের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখ তাঁরা পাননি। এইসব কারণগুলি দেখিয়ে তাঁরা অর্থশাস্ত্র মৌর্য যুগের রচনা ছিল কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তাছাড়া বহু গবেষক মনে করেন, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি একটি উপদেশমূলক রচনা। এটি বিশেষ কোনও রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য বা শাসনব্যবস্থাকে নিয়ে লেখা নয়; এর উপদেশাবলি সবার জন্য। ফলে এক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
অর্থশাস্ত্রের নিরিখে মৌর্য শাসনব্যবস্থার স্বরূপ: কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য অর্থশাস্ত্রকে মৌর্য আমলের ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে ব্যবহার করা সম্ভব বলে মনে করেছেন। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা, অশোকের লেখসমূহ প্রভৃতির সঙ্গে বিচার করে অর্থশাস্ত্রকে মৌর্য শাসনব্যবস্থার উপাদানরূপে গ্রহণ করা হয়।
- মৌর্য সাম্রাজ্যে এক সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাজা স্বয়ং। তাঁকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সর্বোচ্চ বিচারক হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হলেও অর্থশাস্ত্রে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কঠোর নির্দেশ পাওয়া যায়। রাজা ‘মহারাজা’ ও ‘অমাত্য’ নামধারী রাজকর্মচারী নিয়োগ করতেন এবং মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্র শাসন করতেন। মেগাস্থিনিসের বিবরণও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে এই মতগুলিকে সমর্থন করে।
- মৌর্য অর্থনীতি ছিল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে রাজস্বনীতির গুরুত্ব ছিল। রাজস্বের সিংহভাগটাই আসত ভূমিরাজস্ব থেকে। অর্থশাস্ত্রে আপৎকালীন করকে বলা হত প্রণয় কর। কৃষক, কারিগর, বণিক এমনকি বারাঙ্গনারাও উপহারে এই প্রণয় কর দিত।
- মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। তবে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার বিবরণ অর্থশাস্ত্রে তেমনভাবে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ইন্ডিকা থেকে নগর প্রশাসনের কথা জানা যায়।
অর্থশাস্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা: বহু ঐতিহাসিক বলেন, অর্থশাস্ত্রকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে মৌর্য ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- অর্থশাস্ত্রে এক অতিকেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ছবি ফুটে উঠেছে। যেক্ষেত্রে সমাজ ও অর্থনীতির সবকিছুই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাধীন। মৌর্য সাম্রাজ্য সম্পর্কেও একসময় এই একই কথা ভাবা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে এই ভাবনার পরিবর্তন ঘটে।
অর্থশাস্ত্রের নির্দেশ ও মৌর্য শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য: অর্থশাস্ত্রের নির্দেশের সঙ্গে মৌর্য শাসনব্যবস্থার বেশকিছু পার্থক্যও দেখা যায়। যেমন- কৌটিল্য রাজপুরোহিতের উপর গুরুত্ব দিলেও, মৌর্য সম্রাটদের ধর্মবিশ্বাস ও রীতিনীতি পালনের ক্ষেত্রে রাজপুরোহিতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃত হয় না। অশোক একসময় যুদ্ধনীতি সম্পূর্ণ পরিহার করেছিলেন, যা অর্থশাস্ত্রের নির্দেশের সম্পূর্ণ বিপরীত। সর্বোপরি অর্থশাস্ত্র এবং অশোকের শিলালেখতে ধর্মবিজয়ের কথা থাকলেও উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য দেখা যায়।
মিল-অমিল, তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মৌর্য আমলের ইতিহাসের ক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্র একটি সহযোগী উপাদানরূপে গুরুত্বপূর্ণ।
4. জিয়াউদ্দিন বারানি কে ছিলেন? তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
Ans: ভারতের মধ্যযুগের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলেন জিয়াউদ্দিন বারানি (১২৮৫-১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ)। দিল্লি সুলতানির শাসনকালে (১২০৬-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) ইতিহাসচর্চার নির্ভরযোগ্য উপাদান ছিল বারানির রচনাবলি। তাঁর রচিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থ হল- তারিখ-ই- ফিরোজশাহী ও ফতোয়া-ই-জাহান্দারি।
জিয়াউদ্দিন বারানির পরিচয় :
১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের বারান নামক স্থানে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউদ্দিন। এ কারণেই তিনি জিয়াউদ্দিন বারানি নামে পরিচিত হন। তাঁর মাতামহ হুসামউদ্দিন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রিয়পাত্র ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর পিতা মঈদুল মুলক, সুলতান জালালউদ্দিন খলজির পুত্র আরকলি খানের ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। জিয়াউদ্দিন স্বয়ং দীর্ঘ সতেরো বছর মহম্মদ বিন তুঘলকের সভাসদ ছিলেন। পরবর্তীকালে ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে বসলে (১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সুদিনের অবসান ঘটে। সুলতান-বিরোধী ষড়যন্ত্রকারী খাজা জাহানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে বারানিকে পদচ্যুত করা হয়।
জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত গ্রন্থসমূহ :
ফিরোজ শাহ কর্তৃক পদচ্যুত হওয়ার পরবর্তীতে জিয়াউদ্দিন বারানি গ্রন্থ রচনায় মন দেন। ১৩৫২ থেকে ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন, যথা- তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ও ফতোয়া-ই-জাহান্দারি। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থটি সুলতান ফিরোজ শাহের নামে উৎসর্গ করে বারানি সুলতানকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। এর সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে তিনি লিখেছিলেন ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটি। তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে বারানি গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম ৬ বছরের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে ফতোয়া-ই-জাহান্দারির বিষয়বস্তু ছিল মূলত রাষ্ট্রনীতি ও রাজার (সুলতান) ভূমিকা।
(i) তারিখ ই ফিরোজশাহী: জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থটি থেকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজত্বকাল থেকে শুরু করে ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রথম ৬ বছরের শাসনকাল পর্যন্ত অর্থাৎ, মোট ৮ জন সুলতানের প্রায় একশো বছরের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। উক্ত গ্রন্থের ভূমিকাতেই তিনি একজন ইতিহাসকার হিসেবে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। বিভিন্ন সুলতান ও অভিজাত আমলাদের কথোপকথনের বর্ণনাও পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। যেমন-সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে তাঁর পুত্র মহম্মদ ও নাসিরুদ্দিন বুগরা খানের কথোপকথন, সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে বারানির নিজের কথোপকথন ইত্যাদি। এই সকল তথ্য থেকে সমকালীন ধর্ম, প্রশাসন ও রাজনীতি সংক্রান্ত ধারণা পাওয়া যায়, যা দিল্লির সুলতানি শাসন ও জনজীবন সম্পর্কে জানতে ঐতিহাসিকদের প্রভৃত সহায়তা করে। ঐতিহাসিক সামসুল হক-এর মতে, ‘মধ্যযুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে বারানি শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারেন।’
(ii) ফতোয়া-ই-জাহান্দারি: ১৩৫০-এর দশকে জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে সুলতানি যুগে ভারতের রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। অনেকে মনে করেন যে, দীর্ঘ ১৭ বছর মহম্মদ বিন তুঘলকের সভাসদ থাকার দরুন যেহেতু বারানি সরাসরি সরকারি নথিপত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাই তাঁর প্রদান করা তথ্যসমূহ অন্যান্য সমকালীন ঐতিহাসিকদের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য। বারানি রচিত এই গ্রন্থ থেকে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক, সুলতানি শাসনের স্বরূপ, সুলতানের প্রয়োজনীয় গুণাবলি, শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় এ বিষয়ে চব্বিশটি উপদেশ লিপিবদ্ধ করেছেন। বারানির রাষ্ট্রভাবনা, রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত প্রদানে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম।
5. বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি থেকে মধ্যযুগের সুলতানের ইসলামি কর্তব্যগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
Ans: ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে উল্লিখিত সুলতানি ইসলামি কর্তব্যসমূহ
(i) শাসকদের শরিয়ত মান্য করা: মুসলিম জগতে শরিয়তি আইন হল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নির্দেশ। তাই বারানির মতে, মধ্যযুগে সুলতানি শাসকের প্রধান কর্তব্যই হল শরিয়ত বা ইসলামের আদর্শকে রক্ষা করা।
(ii) আইনের সংরক্ষণ: ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে সুলতানের ইসলামি কর্তব্য হিসেবে শরিয়ত বা ধর্মীয় আইনের সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সুলতান প্রয়োজনমতো এই বিধানের সংশোধন বা পরিমার্জনও করতে পারেন।
(iii) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী, ইনসাফ বা ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই বিধান অনুসারে সুলতানি রাষ্ট্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হল সুলতানের প্রধান কর্তব্য। বারানির মতে, ন্যায়বিচার হল মূলত সত্য, ন্যায় ও ধর্মের প্রতিষ্ঠা। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ঈশ্বর বা আল্লাহ্ প্রত্যেক মানুষকে সমান অধিকার দান করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তাই সুলতানের প্রাথমিক কর্তব্য হল প্রজাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষা করা।
(iv) প্রজাদের ধর্মপথে পরিচালনা: সুলতান প্রজাদের ধর্মপথে চালিত করার কাজে নেতৃত্ব দেবেন। অবশ্য বারানি ধর্মপথ বলতে কেবল ইসলাম ধর্মের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।
(v) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ: ইসলামীয় বিধান অনুসারে উৎপন্ন শস্যের ২০%-এর কম বা ৫০%-এর বেশি নয়- এই হারে ভূমিকর আদায় বৈধ। তাই বারানির মতে, ভূমিকর আদায়ের সময় যাতে কৃষকদের উপর অত্যাচার না করা হয়, সে বিষয়ে সুলতানকে সচেতন হতে হবে। তবে ইসলামীয় বিধানের বাইরে আদায় করা অন্যান্য করগুলি অবৈধ।
6. বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি থেকে মধ্যযুগের সুলতানের অন্যান্য কর্তব্যগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
Ans: ফতোয়া-ই জাহান্দারি গ্রন্থে উল্লিখিত সুলতানি শাসকদের অন্যান্য কর্তব্যসমূহ
(i) পদমর্যাদা রক্ষা: বারানির মতে, সুলতানের অন্যতম কর্তব্য হল দরবারে নিজ গাম্ভীর্য বজায় রাখা। জমকালো পোশাক ও জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভা গঠনের মাধ্যমে তিনি প্রজাবর্গের আনুগত্য আদায় করবেন।
(ii) সেনাবাহিনী গঠন: জিয়াউদ্দিন বারানি বলেছেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা, নতুন রাজ্য জয় এবং অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদে একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা হল মুসলমান শাসকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্তব্য।
(iii) সম্পত্তির অধিকার রক্ষা: ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে সুলতানের অপর গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল কোনও মানুষ যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, তা দেখা। তাই সম্পত্তিতে যাতে প্রত্যেকের সমান অধিকার থাকে, সে বিষয়ে সুলতানকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
(iv) গুপ্তচর নিয়োগ: সুলতানকে সমগ্র রাজ্যের সংবাদ বিষয়ে প্রতিনিয়ত অবহিত থাকতে হবে। এর জন্য তিনি একটি সুদক্ষ গুপ্তচর বাহিনী গঠন করবেন।
(v) পরামর্শসভা গঠন: অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারিতা রোধের উদ্দেশ্যে বারানি শাসককে একটি পরামর্শসভা গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন। বলাবাহুল্য অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গই হবেন এর সদস্য। বারানির মতানুযায়ী একমাত্র ঈশ্বরে অনুরাগী শাসকই প্রকৃত অভিজ্ঞ ও জ্ঞানীদের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকেন।
7. ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
Ans: ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র –
গ্রিক শব্দ Theos থেকে উৎপত্তি ঘটেছে Theocracy বা দেবতাতন্ত্র শব্দটির। এই Theos-এর অর্থ হল ঈশ্বর। আর এখান থেকেই এসেছে Theocratic State বা ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের ধারণাটি। ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলতে মূলত সেই সকল রাষ্ট্রকে বোঝায় যেখানে ঈশ্বর হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কোনও প্রতিনিধি মনোনীত করে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ –
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ-
(i) সার্বভৌমত্ব: যে-কোনো ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রেই ঈশ্বরই হলেন সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তিনিই ইহলোক বা পরলোকের প্রভু। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বা শক্তি তাঁর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। তাঁর ইঙ্গিতেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আবর্তিত হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছার ফলশ্রুতিই হল এই জগৎসংসার। পৃথিবীতে সুলতান বা শাসক হলেন তাঁরই প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করাই সুলতানের প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
(ii) আইন ব্যবস্থা: ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে মনুষ্যসৃষ্ট আইনের পরিবর্তে ঈশ্বর নির্দেশিত আইনের ভিত্তিতে শাসন, বিচার ও আর্থিকব্যবস্থা পরিচালিত হয়। যেমন- একটি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে-সমস্ত বিধিবিধান প্রয়োজন, তা আল্লাহর বাণীস্বরূপ পবিত্র কোরানের বিভিন্ন অংশে বর্ণিত আছে (উদাহরণ- অমুসলমানদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা, করব্যবস্থা, নারী ও দাসদের অধিকার, বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি)।
(iii) ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রাধান্য: ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রাধান্য ছিল ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। এইপ্রকার রাষ্ট্রে ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ, যথা- উলেমা, মোল্লা, পোপ বা পুরোহিত শ্রেণির বিশেষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন- ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র এবং ধর্মের প্রধান প্রতিনিধিরূপে খলিফা এবং ইসলামীয় আইনকানুনের ব্যাখ্যাকার হিসেবে উলেমা শ্রেণির প্রাধান্য ছিল সুবিদিত।
(iv) রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা: ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধিবিধানের সংরক্ষণ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য শাসককে বহুক্ষেত্রেই স্বৈরাচারী হতে হয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সুলতানি যুগে দিল্লিতে শাসকগণ অমুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করতেন।
(v) ঐশী গ্রন্থ: প্রায় প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব ধর্মীয় তথা ঐশী গ্রন্থ থাকে। যেমন- ইসলাম ধর্মে কোরান, পারসিকদের জেন্দ আবেস্তা ইত্যাদি। একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রপরিচালনায় সেই ধর্মের ঐশী গ্রন্থ অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
8. জিয়াউদ্দিন বারানি তাঁর ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কী মতপ্রকাশ করেছেন?
Ans: ফতোয়া-ই জাহান্দারি গ্রন্থে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বারানির মত
মধ্যযুগে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটিতে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে-
(i) শরিয়তের নির্দেশ বা ইসলামীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুতি: জিয়াউদ্দিন বারানি তাঁর ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, সুলতানি আমলে সুলতান প্রকাশ্যে শরিয়তের অনুশাসন ও ইসলামের ঐতিহ্য অস্বীকার করতে পারতেন না। তবে তারা উপলব্ধি করেন যে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন তথা স্বৈরশাসন বজায় রাখতে হলে ধর্মীয় দর্শনকে রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিণত করা চলবে না। বারানির মতে, সুলতানরা বহুক্ষেত্রেই শরিয়তের নির্দেশ অমান্য করতেন, যথা- শরিয়ত অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রাণদণ্ড দান নিষিদ্ধ ছিল। অথচ একমাত্র ফিরোজ শাহ তুঘলক ব্যতীত সমগ্র সুলতানি যুগেই শাস্তি হিসেবে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। শরিয়ত তথা ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী, অমুসলিম বা জিম্মিদের নাগরিক অধিকার অস্বীকৃত ছিল। কিন্তু সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় কমসংখ্যক হলেও হিন্দুরা সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত হতে পারত। সুলতানি আমলে সুদগ্রহণ শরিয়ত বিধিসম্মত ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রয়োজনে সুদগ্রহণকে সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
(ii) খলিফার প্রতি আপাত আনুগত্য: জিয়াউদ্দিন বারানির মত অনুযায়ী, দিল্লির সুলতানগণ খলিফাদের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। প্রথমদিকের সুলতানরা অনেকেই রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী খলিফার অনুমোদন গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালের অনেক সুলতানই এই অনুমোদনের প্রত্যাশী ছিলেন না (আলাউদ্দিন খলজি, মহম্মদ বিন তুঘলক প্রমুখ)। আবার সুলতানদের মধ্যে অনেকেই নিজ নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা খোদাই করতেন। মুবারক শাহ নিজেই খলিফা উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সুলতানি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়।
(iii) ধর্মীয় দর্শন ও রাষ্ট্রীয় দর্শনের পৃথক্করণ: সুলতান রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী নিয়মকানুন বা জাওয়াবিত প্রণয়ন করেন। অনেকক্ষেত্রেই সেগুলি শরিয়তের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হত না। শাসনব্যবস্থার সুদৃঢ়করণ ও তাকে দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র দেওয়ার জন্য বহুক্ষেত্রেই দিল্লির সুলতানগণ উপলব্ধি করেন যে, ধর্মনীতিকে রাষ্ট্রনীতির থেকে পৃথক করা বিশেষ প্রয়োজন। এভাবে বারানি দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির বেশকিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন।
9. কৌটিল্য বা চাণক্যের পরিচয় দাও।
Ans: কৌটিল্য বা চাণক্যের পরিচয় –
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে একটি সুপরিচিত নাম হল কৌটিল্য, তিনি চাণক্য বা বিষুগুপ্ত নামেও পরিচিত। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করেন।
(i) প্রথম জীবন: কৌটিল্য ছিলেন মৌর্য যুগের একজন কূটনীতিপরায়ণ ব্রাহ্মণ। তাঁর জন্ম বা ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন যে, আনুমানিক ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (মতান্তরে ৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নাগাদ তাঁর জন্ম হয়। * জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন।
(ii) নন্দ বংশের উচ্ছেদসাধন: শোনা যায়, একবার নন্দ বংশের শেষ রাজা ধননন্দের দরবারে অপমানিত হয়ে কৌটিল্য এই বংশের উচ্ছেদসাধনের প্রতিজ্ঞা করেন। এই সময় তাঁর সাক্ষাৎ হয় চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে। তিনি বালক চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে রাজোচিত লক্ষণ দেখে তাঁকে তক্ষশিলায় নিয়ে যান এবং যুদ্ধবিদ্যা ও রাজনীতিতে পারদর্শী করে তোলেন। শেষপর্যন্ত ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দ্বারা মগধে নন্দবংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে কৌটিল্য মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। অতঃপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে কৌটিল্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও পরামর্শদাতারূপে নিযুক্ত হন।
(iii) অর্থশাস্ত্র রচনা: কৌটিল্য সম্পর্কে সম্যক ধারণালাভের জন্য তাঁর রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটির প্রসঙ্গ উল্লেখ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। মহীশূরের পণ্ডিত ড. আর শ্যামশাস্ত্রী ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিতগণ কৌটিল্যকেই অর্থশাস্ত্রের রচনাকার হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু হল- রাষ্ট্রনীতি। তদুপরি রাজার কর্তব্য, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, যুদ্ধনীতি, প্রজাকল্যাণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর অভিমত ও পরামর্শ এতে লিপিবদ্ধ আছে।
আনুমানিক ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেন। প্রবল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও অসামান্য কূটনৈতিক জ্ঞানের জন্য কৌটিল্য ভারতের ম্যাকিয়াভেলি নামে পরিচিত হন।
10. কৌটিল্যকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলা হয় কেন?
Ans: কৌটিল্যকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলার কারণ –
প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে কৌটিল্য বা চাণক্য একটি অতি পরিচিত নাম। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী তথা মুখ্য উপদেষ্টা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতের রাজনীতিচর্চার একটি অন্যতম নিদর্শনরূপে পরিগণিত হয়। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে উল্লিখিত রাষ্ট্রতত্ত্বের নিরিখে বহু চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিকই কৌটিল্যকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ -এই অভিধায় ভূষিত করেছেন। নবজাগরণের সন্তান এবং বিখ্যাত The Prince গ্রন্থের রচয়িতা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে উভয়ের আলোচনায় যেসকল সাদৃশ্য মেলে, তার ভিত্তিতে কৌটিল্যকে ভারতের ম্যাকিয়াভেলি বলা যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।
(i) রাজার কর্তব্য বিষয়ে মত: কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলি উভয়েই তাঁদের গ্রন্থে রাজার শাসন পরিচালনা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার সঙ্গে রাজ্যের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সেই অনুসারে রাজার কর্তব্য সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন।
(ii) রাজার ক্ষমতা সম্পর্কে মত: কৌটিল্য যেমন রাজার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে অনায়ত্ত এলাকা অর্জন ও তার সুরক্ষা প্রদানের কথা বলেছেন, তেমনই ম্যাকিয়াভেলিও তাঁর গ্রন্থের রাজকুমারকে ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি তা সুরক্ষিতকরণ ও সম্প্রসারণের দিকে নজর দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
(iii) রাষ্ট্রপরিচালনায় নীতি: রাষ্ট্রপরিচালনাতে রাজার সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিষয়টি উভয়েই তুলে ধরেছেন। তাছাড়া তাঁদের মতানুসারে, রাজ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে রাজাকে কূটনীতি, শঠতা, কৌশলগত ধূর্ততা সবকিছুরই আশ্রয় নিতে হবে।
(iv) ইতিহাসবোধ: কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলি -উভয় রাষ্ট্রদার্শনিকই তাঁদের পূর্বসূরিগণ কর্তৃক রচিত সাহিত্য গভীরভাবে পাঠ ও বিশ্লেষণ করেছেন-তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তা গভীর ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। সম্ভবত রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলির দিকে লক্ষ রেখে অনেকেই কৌটিল্যকে ভারতের ম্যাকিয়াভেলি বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অনেকেই এই অভিধা প্রদানের বিরোধিতাও করেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, সময়কালের বিচারে এবং রাষ্ট্রতত্ত্বের নানান বিষয়ে কৌটিল্য ম্যাকিয়াভেলির পূর্বসূরি। রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি-সহ একাধিক বিষয়ে কৌটিল্য বহু পূর্বেই আলোচনা করে গেছেন। তাই ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’-এই অভিধা দিতে তাঁরা নারাজ। অবশ্য মিল-অমিল যাই থাকুক না কেন, প্রাচীন ভারতের এক বাস্তববাদী ও শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদার্শনিক হিসেবে কৌটিল্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
11. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে লেখো।
Ans: প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্য তথা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে যে উপাদানগুলির উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়, সেগুলি হল- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস, এ ছাড়া জাস্টিন, আরিয়ান, স্ট্রাবো ও প্লিনির রচনা ইত্যাদি।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা
(i) কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা
(a) রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা: মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান শাসক, আইনপ্রণেতা, বিচারক ও প্রধান সেনাপতি। তবে সকল ক্ষমতার উৎস হলেও মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজারা কখনোই স্বৈরাচারী ছিলেন না। জনকল্যাণই ছিল তাঁদের শাসনব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য।
(b) সচিব, মন্ত্রীণ ও মন্ত্রীপরিষদ: মৌর্য যুগে সম্রাটকে শাসনকার্যে যারা সাহায্য করতেন, তাদের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সচিব কর্মচারীগণ। সচিবদের মধ্যে থেকে আবার অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের মন্ত্রী বা মন্ত্রীণ পদে নিয়োগ করা হত। তারা শাসননীতি ও পররাষ্ট্র সম্পর্কে রাজাকে পরামর্শ প্রদান করতেন। অন্যদিকে মন্ত্রীপরিষদ নামক সভা ছিল, যার সদস্যগণ কেবলমাত্র জরুরিকালীন অবস্থায় রাজাকে পরামর্শ দিতেন। এ ছাড়া অমাত্য, অধ্যক্ষ, করণিক, দৌবারিক, প্রতিবেদক ইত্যাদি নানা ধরনের কর্মচারীদের অস্তিত্বের কথাও জানা যায়।
(c) সামরিক বিভাগ: মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সুবিশাল সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে জানা যায়। ৩০ জন সদস্য দ্বারা গঠিত একটি পরিষদের উপর মৌর্যদের সামরিক বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। আরও জানা যায় যে, প্রতিটি পরিষদ ৫ জন সদস্য নিয়ে মোট ছয়টি সমিতিতে বিভক্ত ছিল, যথা- পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তিবাহিনী, রথারোহী, নৌবিভাগ, রসদ সংগ্রহ ও যানবাহন।
(d) বিচারব্যবস্থা: মৌর্য রাজারা ছিলেন বিচারব্যবস্থার প্রধান। অর্থশাস্ত্রে ধর্মস্বীয় ও কণ্টকশোধন -এই দুধরনের বিচারালয়ের উল্লেখ মেলে। আবার গ্রামে গ্রামিক ও নগরে নগর ব্যাবহারিক বিচারব্যবস্থার কার্যাবলি পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়। আলোচ্য পর্বে জরিমানা, অঙ্গচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড-এর মতো শাস্তি প্রচলিত ছিল।
(e) রাজস্ব: মৌর্য যুগে সরকারের আয়ের প্রধান উৎসই ছিল ভূমিরাজস্ব। উৎপন্ন ফসলের ১/৬ বা ১/৪ অংশ হারে রাজস্ব ধার্য ছিল। এর পাশাপাশি বিক্রয় কর, জলকর, খনিকর, পথকর, বাণিজ্য কর ইত্যাদি থেকেও সরকারের প্রচুর আয় হত।
(ii) প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যকে প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবন্তী ও দক্ষিণাপথ-এই ৪টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। কোথাও কোথাও প্রদেশগুলিকে বলা হত দেশ। প্রদেশগুলির শাসনকর্তারা পরিচিত ছিলেন প্রাদেশিক নামে। মূলত রাজপরিবারগুলি থেকেই প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ নিযুক্ত হতেন, এদের বলা হত আর্যপুত্র। আবার শাসনের সুবিধার্থে প্রদেশগুলিকে কয়েকটি বিষয় বা অহল-এ (জেলা) বিভক্ত করা হত। জেলার প্রধান শাসনকর্তাকে বলা হত সমাহর্তা। মৌর্য শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম। এই গ্রামের প্রধান পরিচিত ছিলেন গ্রামিক নামে। গোপ-এর অবস্থান ছিল গ্রামিকদের উপরে। তিনি ছিলেন ৫-১০টি গ্রামের প্রধান।
তাছাড়া মেগাস্থিনিস প্রদত্ত বিবরণের মাধ্যমে জানা যায় যে, ৩০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদের উপর পাটলিপুত্র নগরীর শাসনদায়িত্ব অর্পিত ছিল। ৬টি শাখায় বিভক্ত এই পরিষদ ৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হত। কৌশাম্বী, উজ্জয়িনী, তক্ষশিলা প্রভৃতি নগরেও একইরকম শাসনব্যবস্থা বজায় ছিল বলে অনুমান করা হয়।
12. কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্রের কী কী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন? অর্থশাস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার এক সহায়ক উপাদান হিসেবে পরিচিত অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
(i) রাষ্ট্রনীতির
বিজ্ঞান: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রীয় সংগঠন, রাজ্যশাসন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ আলোচনা উপস্থিত। রাষ্ট্রনীতির বিজ্ঞানরূপে এটি বিবেচিত হয়।
(ii) বহুমাত্রিক কাঠামো: কৌটিল্যের এই রাষ্ট্রতত্ত্বের নির্দেশিকায় রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো ছিল বহুমাত্রা সমন্বিত, জনস্বার্থ ও নিরাপত্তাভিত্তিক -যা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
(iii) প্রজাকল্যাণের আদর্শ: আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যরূপে অর্থশাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে যে, প্রজার সুখে রাজার সুখ, প্রজার হিতসাধনই রাজার অন্যতম লক্ষ্য ও দায়িত্ব হওয়া উচিত।
(iv) দূত নিয়োগ: কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খবর আদানপ্রদানের জন্য দূত নিয়োগের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন।
(v) বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য: সর্বোপরি বলা যায় যে, অর্থশাস্ত্রের আলোচনার বিষয়বস্তু নিছক রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যেই সীমিত, তা বলা যায় না। এর পরিধি বহুধাবিভক্ত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনার পাশাপাশি অর্থনীতি, দণ্ডনীতি, রসায়নশাস্ত্র, ইতিহাস, ধাতুবিদ্যা – এরকম নানা বিষয়ের বিজ্ঞানসম্মত ও সুশৃঙ্খল আলোচনা এখানে উপস্থিত।
অর্থশাস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা
রাষ্ট্রের সামাজিক বা অর্থনৈতিক ভিত্তি, প্রজার প্রতি রাজার দায়িত্ব, মন্ত্রীপরিষদের বিন্যাস, রাজস্বব্যবস্থা, গুপ্তচর বিভাগ, নারীর সম্মান ও অধিকার, প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাবতীয় খুঁটিনাটি ধ্যানধারণা অর্থশাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে, যা বর্তমানেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার জগতে অর্থশাস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
- ভারতে কল্যাণকর রাষ্ট্র বা Welfare State-এর বৈশিষ্ট্য অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে, যা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
- নাগরিকদের সুরক্ষা ও অধিকার বিষয়ে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যে আলোচনা উপস্থিত, তাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- বর্তমান শাসনব্যবস্থায় যা যা অনুসৃত হয়, তার প্রায় অধিকাংশই অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে। যেমন- দণ্ড, রাজার বিশিষ্টজনের সঙ্গে গোপন বৈঠক, গুপ্তচর ব্যবস্থা, বহুমাত্রিক শাসনপদ্ধতি ইত্যাদি।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে, অর্থশাস্ত্র বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
13. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত মন্ডলতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত মন্ডলতত্ত্ব
কোনও পরাক্রান্ত রাজা রাজ্যশাসন তথা প্রশাসন পরিচালনার সময় পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে কীরূপ সম্পর্ক স্থাপন করবেন, তার ব্যাখ্যা বা আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সংক্রান্ত আলোচনাই অর্থশাস্ত্রে মণ্ডলতত্ত্ব নামে পরিচিত। মণ্ডলতত্ত্ব ১২ জন রাজাকে নিয়ে গড়ে ওঠায় এটিকে দ্বাদশ মণ্ডল বা রাজমণ্ডল বলা হয়।
এই ১২ জন রাজার মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং বিজিগীষু রাজা, তাঁর সম্মুখভাগে ৫ এবং পশ্চাদ্ভাগে ৪ জন রাজা এবং সেইসঙ্গে রয়েছেন মধ্যম ও উদাসীন রাজা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, দ্বাদশ মণ্ডলের কেন্দ্রে বিজিগীষু রাজার (যাঁরা বিশেষ গুণ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার অধিকারী) অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। * সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি বিচক্ষণতার সাথে অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করা বিজিগীষু রাজার কর্তব্য। কৌটিল্য সম্মুখবর্তী ৫ জন রাজাকে বলেছেন- অরি, মিত্র, অরিমিত্র, মিত্রমিত্র এবং অরিমিত্র মিত্র।
(i) অরি: বিজিগীষু রাজার রাজ্যের সীমান্তবর্তী যে-কোনো রাজ্যের রাজা পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখলে সক্রিয় হতে পারেন, তাই তিনি অরি বা শত্রু।
(ii) মিত্র: সীমান্তবর্তী যে রাজ্য ‘অরি’-র শত্রু, যে বিজিগীষুর মিত্রপক্ষে থাকবে, সে হল মিত্র বা বন্ধু।
(iii) অরিমিত্র: ‘মিত্র’ রাজার সীমান্তবর্তী রাজা হলেন তাঁর স্বাভাবিক শত্রু। অর্থাৎ, ‘অরি’ রাজার মিত্র এবং বিজিগীষু রাজার অরিমিত্র।
(iv) মিত্রমিত্র: ‘মিত্র’ রাজ্যের রাজার স্বাভাবিক মিত্র রাজা হবেন বিজিগীষু রাজার সমর্থক, তাই তিনি মিত্রমিত্র।
(v) অরিমিত্র মিত্র: ‘মিত্রমিত্র’ রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজা হলেন ‘মিত্রমিত্র’-এর শত্রু এবং ‘অরিমিত্র’-এর স্বাভাবিক বন্ধু। তাই তিনি বিজিগীষু রাজার ‘অরিমিত্র মিত্র’।
এ ছাড়া অর্থশাস্ত্রে বিজিগীষু রাজার পশ্চাদ্ভাগের যে ৪ জন রাজার কথা বলা হয়েছে, তাঁরা হলেন-
(i) পার্শ্বিগ্রাহ: পার্শ্বিগ্রাহ অর্থাৎ, পশ্চাদ্বর্তী অঞ্চলের রাজা। তিনি বিজিগীষু রাজার শত্রু এবং ‘অরি’-র মিত্র।
(ii) আকুন্দ: আক্রন্দ অর্থাৎ, পার্শ্বিগ্রাহ রাজ্যের ঠিক পিছনে অবস্থিত রাজ্য এবং পার্শ্বিগ্রাহ-র শত্রু। সেই কারণে বিজিগীষু রাজ্যের মিত্র।
(iii) পার্ষ্ণিগ্রাহাসার: আক্রন্দ রাজ্যের ঠিক পিছনে পার্শ্বিগ্রাহাসার-এর অবস্থান। সেই রাজ্য স্বভাবতই পার্শ্বিগ্রাহের মিত্র এবং বিজিগীষু রাজ্যের শত্রু।
(iv) আকুন্দাসার: আক্রন্দাসার অর্থাৎ, যে রাজ্যের অবস্থান পার্শ্বিগ্রাহাসার রাজ্যের ঠিক পিছনে। এটি আক্রন্দ রাজ্যের মিত্র, তাই বিজিগীষুরও মিত্র।
এর পাশাপাশি কৌটিল্য আরও দুজন রাজার কথা বলেছেন, যথা- মধ্যম ও উদাসীন।
(i) মধ্যম: যে রাজার রাজ্য বিজিগীষু ও অরি রাজ্যের সীমান্তে (মধ্যবর্তী স্থানে) অবস্থিত, তিনি হলেন মধ্যম। এই রাজা বিজিগীষু বা অরি রাজ্য কাউকেই আক্রমণ করতে বা অনুগ্রহ করতে পারেন না।
(ii) উদাসীন: উদাসীন রাজা হলেন সেই রাজ্যের শাসক, যাঁর অবস্থান বিজিগীষু, অরি বা মিত্র রাজ্যের অনেকটা দূরে। এই রাজা একক শক্তিতে অন্য রাজ্যকে আক্রমণ করতে কিংবা অন্য রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম।
গুরুত্ব
রাজমণ্ডল তত্ত্ব দ্বারা কৌটিল্য একজন শাসকের যথার্থ পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের দিকনির্দেশ করেছেন। ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলির দৃষ্টিভঙ্গি কীরূপ হতে পারে এবং সেই কথা বিবেচনা করে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া সম্ভব, তার একটা পূর্বাভাস এই তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়। তাঁর পরামর্শ যে, একজন সঠিক ও বিচক্ষণ রাজা এই তত্ত্বের নিরিখে তাঁর বিদেশনীতির ভারসাম্য রক্ষা করলে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। সর্বপরি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ, বহিঃশত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা করা অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করতে মন্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।
14. সচিত্র মন্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব আলোচনা করো।
Ans: মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব
প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, রাষ্ট্রতত্ত্ব তথা পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বিদেশনীতি কীরূপ হওয়া উচিত, তার এক যুগোপযোগী আলোচনা এই তত্ত্বে স্থান পেয়েছে।
(i) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ: প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ, বহিঃশত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা করা অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে মণ্ডলতত্ত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(ii) ঐক্য ও শান্তিরক্ষা: কৌটিল্য বিজিগীষু রাজাকে কেন্দ্র করে মোট ১২ জন রাজার সমবায়ে রাজমণ্ডল গড়ে তুলেছেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ঐক্য, শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকবে।
(iii) শত্রু-মিত্র নির্ধারণ: দ্বাদশ মণ্ডলের ১২টি রাজ্যের মধ্যে কাকে কীভাবে গ্রহণ করতে হবে, তার সঠিক বিশ্লেষণ মণ্ডলতত্ত্বে আলোচিত হয়েছে। এভাবে প্রকৃত শত্রু ও মিত্র নির্ধারণ করে বিজিগীষু রাজা সকলপ্রকার আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হবেন বলে অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে।
(iv) ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব: মণ্ডলতত্ত্বে প্রতিটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বিজিগীষু রাজ্যের রাজার Balance of Power বা ক্ষমতার ভারসাম্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
(v) বর্তমান যুগে প্রাসঙ্গিকতা: প্রাচীন ভারতে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব বর্তমান যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কৌটিল্য আন্তঃরাজ্য সম্পর্ক পরিচালনার যে নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেছেন, তা বর্তমান যুগের পররাষ্ট্রনীতিকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের মণ্ডলতত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক হলেও রাষ্ট্রজোট ও পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলে। তাই বর্তমান কালেও এর সমান প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
15. কৌটিল্যের দন্ডনীতি ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
Ans: কৌটিল্যের দণ্ডনীতি
কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে দণ্ডনীতির উল্লেখ মেলে। এই দণ্ড শব্দটি ব্যাপক ব্যঞ্জনাময়। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, দণ্ড বা শাস্তি এবং শাস্তির ভীতিকে শুধু প্রতিরোধমূলক দিক থেকেই বিচারবিবেচনা করা উচিত নয়। এই দণ্ড সমাজে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণে দণ্ডনীতি সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থিত।
(i) অর্থশাস্ত্রে দন্ড-লাঠি বা শাস্তি অর্থ: কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে দণ্ডকে লাঠি অর্থে ব্যবহার করেছেন। এখানে ‘দণ্ড’ শব্দের অপর অর্থ হল শাস্তি। সামরিক বাহিনী অর্থে: কৌটিল্য দণ্ড শব্দটি সামরিক বাহিনী -এই অর্থেও ব্যবহার করেছেন।
(ii) শাস্তিপ্রদানের কৌশল অর্থে: আবার কৌটিল্য দণ্ডনীতিকে শাস্তিপ্রদানের কৌশল (art of punishment) রূপেও বর্ণনা করেছেন।
(iii) ক্ষমতা অর্থে: অনেকে বলেন, আধুনিক রাজনীতিতে ক্ষমতা
বিজ্ঞান শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, দণ্ডনীতি ছিল সেই ধরনের ধারণারই প্রকাশ। কৌটিল্য দণ্ডনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল ও বলপ্রয়োগের বস্তুগত ধারণা তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি ক্ষমতাতত্ত্বকে রাষ্ট্রপরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন।
কৌটিল্যের দণ্ডনীতির বৈশিষ্ট্য
কৌটিল্যের দণ্ডনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
(i) শৃঙ্খলা: দণ্ড হল শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ। ড. বিশ্বনাথ প্রসাদ ভার্মা বলেছেন, ‘Danda is rooted in discipline’। কারণ হিসেবে বলা হয়, সকল সজীব প্রাণীর নিরাপত্তা ও মঙ্গলের জন্য দণ্ড প্রয়োজন।
(ii) বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ: কৌটিল্য দণ্ডনীতিকে লাঠি বা সেনা অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি ‘দণ্ডপানি’ শব্দেরও প্রয়োগ করেছেন। তাঁর মতে, দণ্ডের কলাকৌশল (art) বিভিন্ন বিষয়ের (অধিগ্রহণ, বৃদ্ধি ও বণ্টন পদ্ধতি) সঙ্গে যুক্ত।
(iii) উপযুক্ত দণ্ড: কৌটিল্যের মতে, লঘুপাপে গুরুদণ্ড জনসাধারণকে ক্ষুব্ধ করে। আবার গুরুপাপে লঘুদণ্ড রাজাকে বিপদগ্রস্ত করে। সুতরাং, যথাযথ বিচারবিবেচনা করেই দণ্ড প্রদান করা উচিত।
(iv) সুন্দর সমাজগঠন: কৌটিল্যের মতে, দণ্ডনীতির সাহায্যেই রাজা ধনী-দরিদ্র, শক্তিমান-দুর্বল-এর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দণ্ডনীতি একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মানুষের বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দণ্ড বিশেষ কার্যকর। তাই কৌটিল্যের দণ্ডনীতি গভীর অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
16. রাজার ক্ষমতা ও গুণাবলি সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে কী বলা হয়েছে?
Ans: প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রনীতি এবং রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র হল একটি আকর গ্রন্থ। রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি লিপিবদ্ধকরণের পাশাপাশি উক্ত গ্রন্থে রাষ্ট্রের শাসক বা রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি ও কার্যাবলি সম্পর্কেও বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
রাজার ক্ষমতা
অর্থশাস্ত্রের আলোচনা অনুযায়ী, রাজা ছিলেন বহুবিধ ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে রাজার অধিষ্ঠান- তিনিই যাবতীয় পার্থিব বিষয়ে চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তবে এক্ষেত্রে কোনোভাবেই রাজার অবাধ ও শর্তহীন ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়নি। কৌটিল্য-র মতে, রাজার বহুবিধ ও ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও তা ছিল সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজা মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন, যদিও সেই পরামর্শ গ্রহণ করতে তিনি বাধ্য নন।
রাজার গুণাবলি
কৌটিল্যের বক্তব্য অনুসারে রাজা গুরুদায়িত্ব সম্পাদনের জন্য রাজা অপরিহার্য চতুর্বিধ গুণের অধিকারী হবেন।
(i) উত্থান গুণ বা উৎসাহ গুণ: উত্থান গুণ (উৎসাহ গুণ) হল সর্বদা সবস্থানে সকল কাজে নিযুক্ত থাকার গুণ- এই গুণের দ্বারা রাজার মধ্যে থাকবে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং কর্মপ্রেরণা, পাশাপাশি সাহস ও অতি দ্রুততার সঙ্গে কোনও কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতা। রাজার মধ্যে এই গুণগুলি থাকলে রাজকর্মচারীদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়বে। অন্যদিকে রাজা উদ্যমহীন হলে প্রজাদের মধ্যেও তার প্রভাব পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্য ও রাজ্যবাসীর স্বার্থ বিপন্ন হবে।
(ii) অভিগামিক গুণ: ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মপরায়ণতা, শত্রুদমনের দক্ষতা, বিবেচনার দৃঢ়তা, বিনয় প্রভৃতি গুণকে রাজার অভিগামিক গুণ বলা হয়। রাজার এইসব গুণ থাকলে প্রজারা রাজার প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং রাজার আনুগত্য স্বীকার করবে।
(iii) ব্যক্তিগত গুণ: বিপদে-আপদে সংযম ও স্থিরতা, বাষ্পটুতা, ইন্দ্রিয় সংযম, প্রখর ধীশক্তি, প্রসন্নচিত্তে মনোভাব গোপন করার ক্ষমতা, তীক্ষ্ণ মেধা ইত্যাদি হল রাজার ব্যক্তিগত গুণ। এই সকল গুণাবলি রাজার অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।
(iv) প্রজ্ঞাগুণ: রাজার প্রজ্ঞাগুণ বলতে কৌটিল্য মনে করেন যে, রাজা হবেন প্রখর স্মৃতিশক্তি, নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ও যে-কোনো সমস্যাসমাধানের ক্ষমতার অধিকারী। এই সকল গুণাবলি রাজাকে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করে তুলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজার প্রজ্ঞাগুণ রাজকার্য সম্পাদনে বিশেষ সহায়তা করে।
মূল্যায়ন
কৌটিল্যের মতে, আদর্শ রাজা হবেন একইসঙ্গে রাজা এবং ঋষি উভয়ের গুণের সমাহার। ইন্দ্রিয়সংযমী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ষড়রিপু, অর্থাৎ ক্রোধ, কাম, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য প্রভৃতি তাঁর বশীভূত হবে। তিনি আরও বলেন, রাজা হবেন কর্মতৎপর ও সত্যভাষী। তিনি সর্বদা মার্জিত আচরণ অবলম্বন করবেন এবং সর্বপ্রকার চিত্তচাঞ্চল্যকে জয় করে বিশেষ গুণসম্পন্ন আদর্শ রাজায় পরিণত হবেন।
রচনাধর্মী | রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | WB Class 11 History Rastrer Prokriti Descriptive Question and Answer:
1. সেনেকার রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
Ans: রোমানদের নির্বিকারবাদী দর্শনের ক্ষেত্রে যেসকল দার্শনিক বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সেনেকা দ্য ইয়ংগার (Lucius Annaeus Seneca the Younger)। তিনি ছিলেন সম্রাট নিরোর শিক্ষক এবং তার একজন মন্ত্রী। একাধারে দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক ও নাট্যকার হিসেবে সেনেকার খ্যাতি ছিল সুবিদিত। তাঁর সমৃদ্ধ রাষ্ট্রচিন্তা বিশ্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানচর্চাকে বিশেষভাবে পরিপুষ্ট করেছিল।
সেনেকার রাষ্ট্রচিন্তা / রাষ্ট্রদর্শন :
সেনেকার রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রে আছে মানুষের স্থান। মানুষের মধ্যে সৎ ও অসৎ-উভয় গুণের সমাবেশ ঘটা সম্ভব বলেই তিনি মনে করতেন। তবে প্রকৃত কল্যাণকামী রাষ্ট্রজীবন গড়ে তোলার জন্য তিনি মানুষের সদ্গুণাবলির বিকাশকেই একমাত্র পথ বলে মনে করেন।
রাষ্ট্রদর্শনের মৌলিক শর্তসমূহ :
সেনেকার রাষ্ট্রদর্শনের মৌলিক শর্তগুলি হল-
- রাষ্ট্র শক্তি বা আইনের উপর নির্ভরশীল হবে না। রাষ্ট্র হবে একটি বৃহত্তর সমাজ। যে সমাজের চরিত্র হবে ধর্মীয় এবং নৈতিক।
- দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিশৃঙ্খল জনগণ একটি রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক। সেনেকা যেসময় রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনায় রত ছিলেন সেসময় রোম-এর অবস্থা ছিল বেশ সংকটজনক-তবে এই সংকটের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল মূলত দুর্নীতি ও অদূরদর্শিতার কারণে। জনগণ এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল যে তিনি মনে করতেন দুর্নীতিগ্রস্ত জনগণ অপেক্ষা স্বৈরাচারী শাসনই শ্রেয়।
- গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার থেকে স্বৈরাচারী শাসন জনসমাজের শান্তি ও প্রগতির পক্ষে বেশি কার্যকরী। তবে নৈতিকতাসমৃদ্ধ জনসমাজের প্রতিষ্ঠা হলে, কোনও ব্যক্তি বা আইনের শাসন দরকার হবে না। এই নৈতিকতার মর্মকথা হল সর্বোচ্চ সদগুণাবলি অর্জন, বিলাসিতার জীবন পরিহার করা, সুখী ও নিষ্পাপ জীবনযাপন করা, গুণীজনকে শ্রদ্ধা করা ইত্যাদি।
- উচ্ছৃঙ্খল ও অসৎ মানুষের জন্যেই সরকারের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ সরকার ও আইনকানুন হল বিপথগামী মানুষকে পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে ঈশ্বর মনোনীত একটি প্রতিষ্ঠান।
- মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ ধর্ম হল মানবসেবা বা সমাজসেবা। রাষ্ট্রক্ষমতা বা সরকারের কর্তৃত্ব এই ধর্মের বিরোধী।
- রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ মানবসেবার জন্য শ্রেষ্ঠ বিকল্প নয়। প্রকৃত জ্ঞানী ও সৎ ব্যক্তিরাই মানবতার শ্রেষ্ঠ সেবক হওয়ার উপযুক্ত। উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টান আনুগত্য ও ভাবনার প্রচারে সেনেকার তত্ত্ব পরবর্তীতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
দুই কমনওয়েলথ তত্ত্ব :
সেনেকার রাষ্ট্রচিন্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল- দুই কমনওয়েলথ তত্ত্ব। এই দুই কমনওয়েলথ হল- পৌর রাষ্ট্র (Civil State) ও বৃহত্তর রাষ্ট্র (Greater State) প্রত্যেক মানুষ দুটি কমনওয়েলেথের সদস্য। একদিকে যেমন সে পৌররাষ্ট্রের সদস্য আবার বিবেকবুদ্ধি ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে গঠিত বৃহত্তর রাষ্ট্রেরও সদস্য। সেনেকা বর্ণিত বৃহত্তর রাষ্ট্র আসলে রাষ্ট্র বলতে যা বোঝানো হয় তা ছিল না- ছিল সমাজ, যেখানে সদস্যগণ নীতিগত ও ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। রাজনৈতিক গুণবর্জিত অথবা রাজনীতি সম্পর্কে নিস্পৃহ বেশকিছু বিদ্বান মানুষ এখানে সমাজসেবায় সচেষ্ট হবে। এই পথেই সেনেকার রাষ্ট্রদর্শন হয়ে উঠেছে চরম নীতিজ্ঞানমূলক।
শাসক সম্পর্কে অভিমত :
সম্রাট নিরোর সময়কালে রোমান সমাজ ও রাজনীতি ব্যাপক দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচার রোমান সাম্রাজ্যকে গ্রাস করেছিল। সেনেকার বক্তব্য ছিল এরূপ পরিস্থিতিতে কোনও সৎ, শিক্ষিত, জ্ঞানী ব্যক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে ভালো কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতেন না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা স্বৈরাচারীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন অথবা ব্যবস্থাটি ত্যাগ করে চলে যান। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে কম জ্ঞানী, কম শিক্ষিত, কম সৎ কিন্তু রাষ্ট্রশাসনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে এরকম ব্যক্তি ক্ষমতায় এলে মানুষের যথেষ্ট মঙ্গলসাধন করতে পারেন। সেনেকার দৃষ্টিতে এরা হলেন ভালো নেতা এবং এদের পরিচালিত সরকার হল ভালো সরকার। বস্তুতপক্ষে সেনেকা ভিন্নতর উপায়ে নিজের নির্বিকারবাদী দর্শন প্রচার করেছেন অক্লান্তভাবে।
সমাজসেবা বিষয়ে মন্তব্য :
সেনেকা বলেছেন যে, বেশিরভাগ বিজ্ঞ ও শিক্ষিত ব্যক্তি সুশাসক হতে পারেন না। ভোগবাদকে দূরে সরিয়ে রেখে তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অপরের জন্য কল্যাণমূলক কাজ তথা সমাজসেবার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
জনগণের অধিকার ও দাসদের সম্পর্কে মন্তব্য :
জনগণের অধিকার ও দাসদের প্রতি আচার-ব্যবহার বিষয়েও সেনেকার রাষ্ট্রদর্শনে আলোচনা রয়েছে। তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে তিনি নির্বিকারবাদ নির্দেশিত ভ্রাতৃত্ববোধের মহিমাময় দিকটির কথা তুলে ধরেছেন। সামাজিক ভেদাভেদ তাঁর কাছে ছিল চরম নিন্দনীয় এক বিষয়। দাসদের সমগ্র মানবসত্তা কেনাবেচা যায় না বলে উল্লেখ করে তিনি দাসদের রক্ষার কথা প্রকাশ করেন। যদিও এই ব্যবস্থাকে তিনি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলা যায় না।
ধর্মীয় ভাবনা :
সেনেকার রাষ্ট্রদর্শনে ধর্মীয়ভাব লক্ষণীয়। মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কথা তিনি বলেছিলেন, বলাবাহুল্য রোমান সাম্রাজ্যে সদ্য বিস্তৃত খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে সেনেকার দর্শন গুরুত্ব পেয়েছিল। সেনেকা মানুষের রাজনৈতিক গুণাবলির চেয়ে ক্ষমা, দয়া, দান, সহিষ্ণুতা প্রভৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রাক রাষ্ট্রীয় আদিম পর্বে সরকার বা আইনের প্রয়োজন ছিল না- ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটার দরুন মানুষ লোভী ও স্বার্থপর হতে থাকলে সরকার বা রাষ্ট্রের প্রয়োজন দেখা দেয়। অর্থাৎ সরকারকে মন্দ প্রবৃত্তির প্রতিষেধক বলা যায়। ক্রমেই সেনেকার দর্শন খ্রিস্টান ধর্মের প্রাথমিক চিন্তাধারার ভিত্তি হয়ে উঠতে থাকে।
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রে সিসেরো এবং সেনেকার দর্শনের মধ্যে বহুক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য ও বিরোধিতা লক্ষ করা যায়। তবে রোমান রাষ্ট্রচিন্তায় সেনেকার বক্তব্য বা মতবাদের গুরুত্ব যে বহুবিধ একথা বলাই যায়।
2. সংক্ষেপে লেখো- নতুন রাজতন্ত্র ও টমাস ক্রমওয়েলের অবদান।
Ans: পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক নতুন ধরনের সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশে প্রথম আধুনিক জাতিরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে রাজতন্ত্র বিকাশলাভ করে, যা নব্য রাজতন্ত্র নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে সপ্তম হেনরির (Henry VII) রাজত্বকাল এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। তাঁর উত্তরসূরি অষ্টম হেনরির (Henry VIII) আমলে এই রাজতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ও প্রধানমন্ত্রী টমাস ক্রমওয়েল-এর অবদান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতপক্ষে, ক্রমওয়েলের উদ্যোগেই ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নতুন রাজতন্ত্র বা নব্য রাজতন্ত্র :
সপ্তম হেনরির হাত ধরেই ইংল্যান্ডে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে। তাঁর শাসনকালে। ইংল্যান্ডে আইন, শাসন, বিচার, ধর্ম, পার্লামেন্ট এমনকি পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে নতুন নতুন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তিনি সংসদকে (পার্লামেন্ট) নিজের কর্তৃত্বাধীনে এনে, আর্থিক উন্নতিসাধনের মাধ্যমে অভিজাত শ্রেণির উপর নির্ভরশীলতাকে হ্রাস করে রাজতন্ত্রকে যেভাবে নবরূপ দান করেছিলেন- তা ইতিহাসে নতুন রাজতন্ত্র নামে পরিচিতি লাভ করে। ঐতিহাসিক জন রিচার্ড গ্রিন (John Richard Green) সর্বপ্রথম তাঁর গ্রন্থে টিউডর রাজতন্ত্রকে নব্য রাজতন্ত্র (New Monarchy) আখ্যা দেন।
সপ্তম হেনরি প্রবর্তিত এই নব্য রাজতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হল-
(i) রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
ইংল্যান্ডের সিংহাসনের অধিকারকে কেন্দ্র করে ইয়র্ক হাউস (House of York) ও ল্যাঙ্কাস্টার হাউসের (House of Lancaster) মধ্যে দীর্ঘ ৩০ বছরব্যাপী গোলাপের যুদ্ধ (War of the Roses, ১৪৫৫-১৪৮৫/১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ) সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে বসওয়ার্থের যুদ্ধে (Battle of Bosworth) ল্যাঙ্কাস্টার বংশীয় রিচমন্ডের আর্ল হেনরি (Henry Tudor, Earl of Richmond) পরাস্ত করেন ইয়র্ক বংশীয় তৃতীয় রিচার্ড (Richard III)-কে। এরপর আর্ল হেনরি সপ্তম হেনরি উপাধি গ্রহণ করে ইংল্যান্ডে টিউডর (Tudor) রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজার ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। এসময় সপ্তম হেনরি ইয়র্কশায়ার গোষ্ঠীভুক্ত চতুর্থ এডওয়ার্ডের (Edward IV) কন্যা এলিজাবেথ (Elizabeth of York)-কে বিবাহ করলে, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়র্ক হাউস ও ল্যাঙ্কাস্টার হাউস ঐক্যবদ্ধ হয়। এতে যে রাজনৈতিক ঐক্যের সূচনা হয়, তা ইংল্যান্ডের আয়তন, শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
(ii) পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা
পার্লামেন্টের সঙ্গে সপ্তম হেনরির সম্পর্ক ও নীতি ছিল বেশ চমকপ্রদ ও বৈপ্লবিক। Livery ও Maintenance আইন দ্বারা সপ্তম হেনরি সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করে রাজার ক্ষমতা সুসংহত করতে উদ্যত হন। বলা যায় যে, স্বল্প সময়ের জন্য এবং সংখ্যায় কম পার্লামেন্ট ডাকলেও তার মধ্যেই পার্লামেন্টের মাধ্যমে তিনি যত সংখ্যক আইন প্রণয়ন করেছিলেন তা 1 আগে কখনও হয়নি। ফলে পার্লামেন্টের গুরুত্ব এসময় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
(iii) সামন্তদের দমন
রাজত্বের শুরু থেকেই সপ্তম হেনরি সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা সংকুচিত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালে স্পেন, ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ডের রাজপরিবারগুলির সঙ্গে ইংল্যান্ডের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলস্বরূপ সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং টিউডর রাজবংশের মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধি পায়।
(iv) মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব
টিউডর আমলে ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজতন্ত্রের সমর্থকে পরিণত হয়।
(v) সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন
সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডে সামন্ত শ্রেণির প্রভাবমুক্ত এক সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা প্রণয়নে সচেষ্ট হন। এই সময় ইংল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে সপ্তম হেনরি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।*
টমাস ক্রমওয়েলের অবদান :
ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম রূপকার টমাস ক্রমওয়েল (Thomas Cromwell) ছিলেন রাজা অষ্টম হেনরির প্রধান পরামর্শদাতা ও সচিব। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কার্ডিনাল উলসির (Cardinal Thomas Wolsey) সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং এসময় থেকেই ইংল্যান্ডের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এই সময় অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত সমস্যার নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ উলসিকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদচ্যুত করা হয় এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন টমাস ক্রমওয়েল। পরবর্তীকালে ক্রমওয়েল রাজা অষ্টম হেনরির ভাইকার জেনারেল ও চ্যান্সেলার পদেও নিযুক্ত হন। নব্য রাজতন্ত্রের টমাস ক্রমওয়েল আদর্শকে সুদৃঢ় ভিত্তি প্রদান করতে ক্রমওয়েল যেসকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হল-
(i) চার্চে রাজার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা
ইংল্যান্ডের শাসক অষ্টম হেনরি এবং রানি ক্যাথরিন (Catherine of Aragon)-এর বিবাহবিচ্ছেদকে কেন্দ্র করে পোপের সঙ্গে রাজার বিরোধ দেখা দেয়। পোপ নানাভাবে অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদে অনুমতি দানের বিষয়ে বিলম্ব করতে থাকেন। এমতাবস্থায়, ক্রমওয়েল অষ্টম হেনরিকে পরামর্শ দেন যে এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে, রাজার উচিত নিজেকে ইংল্যান্ডের চার্চের সর্বময় কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ক্রমওয়েলের উদ্যোগে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ধর্মযাজকগণ Christ Doth-এর অনুমোদনক্রমে রাজা অষ্টম হেনরিকে ইংল্যান্ডের চার্চের সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ভিত্তিতে রাজার কর্তৃত্বকে বৈধতা প্রদানের উদ্দেশ্যে, ক্রমওয়েলের উদ্যোগে নানা আইন পাস হলে চার্চগুলিতে পোপের পরিবর্তে রাজার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ii) ধর্মসংস্কার
জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ও রাজার ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিতে হলে, তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় পোপতন্ত্র, যাজক কিংবা মঠতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন ক্রমওয়েল। তাঁর উদ্যোগে ইংল্যান্ড থেকে রোমান চার্চকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পার্লামেন্টকে ব্যবহার করা হয়েছিল। রাজার প্রতি অনুগত এই পার্লামেন্টই ইতিহাসে পরিচিত রিফরমেশন পার্লামেন্ট (English Reformation Parliament, ১৫২৯-১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ) নামে। এই পার্লামেন্টে রাজা অষ্টম হেনরির পক্ষে বিভিন্ন আইন পাস করা হয়, যেমন- প্রোবেট অ্যান্ড মরচুয়ারি অ্যাক্ট, অ্যাক্ট অফ প্লুরালিটিজ, রেসট্রেন্ট অফ অ্যাপিলস ইত্যাদি। বস্তুতপক্ষে, রিফরমেশন পার্লামেন্ট প্রণীত এই সকল আইন দ্বারাই ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার সম্পূর্ণ করা হয়।
(iii) জাতীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি
নব্য রাজতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য জাতীয় সার্বভৌমত্বের নীতি রূপায়ণে টমাস ক্রমওয়েল বদ্ধপরিকর ছিলেন। এক্ষেত্রে ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি (Act of Supremacy) আইনটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই আইন অনুসারে ইংল্যান্ডের রাজাকে চার্চের প্রধান কর্তৃত্বরূপে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এভাবেই চার্চ ও রাষ্ট্র উভয়ের উপরেই রাজার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
(iv) মঠের প্রাধান্য খর্ব
ইংল্যান্ডে চার্চের মতো মঠগুলিরও দৌরাত্ম্য কম ছিল না। অনেকক্ষেত্রে তারা রাজার শাসন অগ্রাহ্য করত, যা একটি জাতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল ক্ষতিকারক। এই চরম সত্য উপলব্ধি করে টমাস ক্রমওয়েল মঠগুলি ধ্বংসসাধনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ক্রমওয়েল মঠগুলির ধ্বংসসাধনের উদ্দেশ্যে দুটি আইন পাস করেন যথা- প্রথম উচ্ছেদ আইন (১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ও দ্বিতীয় উচ্ছেদ আইন (১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। এই ঘটনার দরুন মঠগুলি রাজার নিয়ন্ত্রণে আসে ও ইংল্যান্ডে রাজার ক্ষমতা, মর্যাদা ও আর্থিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
(v) প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন
ক্রমওয়েল প্রশাসনের মধ্যযুগীয় কাঠামোর অবসান ঘটিয়ে জাতীয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থায় রাজা দুর্বল হলেও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় না কারণ এই শাসনকাঠামোর শীর্ষে থাকেন মন্ত্রীসভা। এ ছাড়া ১৯ জন সদস্যকে নিয়ে ক্রমওয়েল প্রিভি কাউন্সিল (Privy Council) গঠন করেন এবং নিজে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পদে আসীন হন।
(vi) অর্থবিভাগের সংস্কার
আর্থিক প্রশাসনিক বিভাগ প্রবর্তন করে ক্রমওয়েল আয় বৃদ্ধি করেন। আর্থিক বিষয় দেখাশোনার জন্য তিনি ছ’টি পৃথক বিভাগ প্রবর্তন করেন। এইভাবে মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা থেকে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো প্রবর্তন করে ইংল্যান্ডে নব্য রাজতন্ত্রের সত্তাকে টমাস ক্রমওয়েল জাগরিত করেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক ইংল্যান্ডের শাসনকাঠামোর বিকাশে টমাস ক্রমওয়েল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলির দরুনই ইংল্যান্ডে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
3. টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারগুলি সম্পর্কে যা জানো লেখো।
Ans: ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, পররাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারগুলি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারসমূহ :
ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির প্রধান পরামর্শদাতা ও সচিব হিসেবে, টমাস ক্রমওয়েল যেসকল সংস্কারসাধন করেছিলেন সেগুলি হল-
(i) পোদের প্রাধান্য খর্ব –
ইংল্যান্ডের শাসক অষ্টম হেনরির সঙ্গে রানি ক্যাথরিনের বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রশ্নে পোপের সঙ্গে রাজার প্রবল বিরোধ দেখা দেয়। ইংল্যান্ডের উত্তরাধিকারী হিসেবে একটি পুত্রসন্তান লাভের আশায়, ক্যাথরিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অষ্টম হেনরি অ্যান বোলিন (Anne Boleyn)-কে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে পোপ অনুমতি দিতে বিলম্ব করেন। এই পরিস্থিতিতে অষ্টম হেনরিকে সমর্থন করে ক্রমওয়েল পোপের ক্ষমতা খর্ব করতে উদ্যত হন। তাঁর উদ্যোগে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে, Christ doth-এর অনুমোদনের ভিত্তিতে রাজা অষ্টম হেনরিকে ইংল্যান্ডের চার্চের সকল ক্ষমতার অধিকারী ঘোষণা করা হয়। এইভাবে চার্চগুলিতে রাজার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে পোপের প্রাধান্য খর্ব করা হয়।
(ii) চার্চের জাতীয়করণ –
ইংল্যান্ডে জাতীয় প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েল পাদুয়ার মার্সিলিও (Marsilio Ficino)-এর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মার্সিলিও যেমন পোপের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সম্রাটের কর্তৃত্বের দাবি জানান, ঠিক সেরকমই ক্রমওয়েলও এই মত অনুযায়ী পোপের ক্ষমতাকে খর্ব করে রাজা বা সম্রাটকে সকল ক্ষমতার অধিকারী করে তোলেন। এই রাজতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় ক্রমওয়েলের উদ্যোগে ইংল্যান্ডে জাতীয় চার্চ গড়ে তোলা হয়। এর ফলে রোমান চার্চের সঙ্গে সবরকমের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং দেশে জাতীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
(iii) রিফরমেশন পার্লামেন্ট –
ইংল্যান্ড থেকে রোমান চার্চকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ক্রমওয়েলের সক্রিয়তায় পার্লামেন্টকে কাজে লাগানো হয়েছিল যা ইতিহাসে রিফরমেশন পার্লামেন্ট নামে পরিচিত (১৫২৯-১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। রাজা অষ্টম হেনরি ৩ নভেম্বর, ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্রমওয়েলের পরামর্শে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। এই পার্লামেন্টে অষ্টম হেনরির পক্ষে নানা আইন পাস করা হয়, যেমন- প্রোবেট অ্যান্ড মরচুয়ারি অ্যাক্ট, অ্যাক্ট অফ প্লুরালিটিজ, স্ট্যাটুট অফ প্রেমুনিয়ার, অ্যাক্ট ইন রেসট্রেন্ট অফ অ্যানেটস, অ্যাক্ট ইন রেসট্রেন্ট অফ অ্যাপিলস, অ্যাক্ট অফ সাকসেশন, অ্যাক্ট অফ ট্রিজন ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিল ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে পাস হওয়া অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি (Act of Supremacy) আইনটি। এই আইনে ইংল্যান্ডের সমস্ত চার্চের প্রধান হিসেবে রাজার সার্বভৌমত্বকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
(iv) মঠব্যবস্থার উচ্ছেদ –
পোপের অর্থসংগ্রহের অন্যতম কেন্দ্র ছিল মঠ। অষ্টম হেনরি বুঝতে পারেন যতদিন মঠের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন পোপ তাঁর প্রভাব বজায় রাখতে পারবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহের কারণে রাজার রাজকোশ শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তাই অষ্টম হেনরি এসময় মঠগুলির সম্পত্তি লাভ করতে আগ্রহী হয়। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন টমাস ক্রমওয়েল। মঠ বিলোপের ক্ষেত্রে তিনি যে দুটি আইন পাস করেন তা হল-
- প্রথম উচ্ছেদ আইন: ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উচ্ছেদ আইনটি প্রবর্তন করা হয়। যেসব মঠগুলির বাৎসরিক আয় ২০০ পাউন্ড-এর কম সেই মঠগুলিকে দুর্নীতির অভিযোগে ভেঙে দেন। এর ফলাফলস্বরূপ উত্তর ইংল্যান্ডে এক বিদ্রোহের সূচনা হয় যা পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস (Pilgrimage of Grace) নামে পরিচিত। টমাস ক্রমওয়েল এই বিদ্রোহকে কঠোর হাতে দমন করেন।
- দ্বিতীয় উচ্ছেদ আইন: ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে অবশিষ্ট বৃহৎ মঠগুলির উচ্ছেদ করা হয় এই আইনের মাধ্যমে এবং সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাজার হস্তগত করা হয়।
(v) গ্রেট বাইবেল-এর সংস্করণ –
ইতিপূর্বে খ্রিস্ট ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল মূলত লাতিন ভাষায় ছাপা হত। এইসব লাতিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় মুদ্রিত বাইবেল ইংল্যান্ডে প্রচলিত ছিল। টমাস ক্রমওয়েল ইংরেজি ভাষায় বাইবেল অনুবাদের জন্য মাইলস কভারডেল (Myles Coverdale)-কে নির্দেশ দেন। শেষপর্যন্ত ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট বাইবেল প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষায়। এই বাইবেল প্রতিটি চার্চে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।
(vi) প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তন –
ক্রমওয়েল যখন ক্ষমতায় আসে তখন প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মধ্যযুগীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠিত ছিল। টমাস ক্রমওয়েল তা পরিবর্তন করে জাতীয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামো প্রবর্তন করেন। তিনি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশাসন ও সরকারকে ঢেলে সাজান। এর পাশাপাশি ক্রমওয়েল মোট ১৯ জন কাউন্সিলারকে নিয়ে প্রিভি কাউন্সিল গঠন করেন। এ ছাড়াও রাজা ব্যক্তিগত সেক্রেটারি পদ গঠন করেন। ক্রমওয়েল নিজেই এই পদ গ্রহণ করেন এবং নিজেকে প্রশাসনের প্রধানরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আধুনিকতা নিয়ে আসেন।
(vii) অর্থনৈতিক পদক্ষেপ –
আলোচ্য পর্বে ক্রমওয়েল আর্থিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। তিনি এক্সচেকার (Exchequer), ডাচি অফ ল্যাঙ্কাস্টার (Duchy of Lancaster) এর মতো নতুন নতুন অর্থবিভাগের স্থাপনা করেন। তাঁর সংস্কারের দরুন রাজার আয় প্রায় দুগুণ বৃদ্ধি পায়।
(viii) পররাষ্ট্রনীতি –
ক্রমওয়েলের উদ্যোগে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাছাড়া ইংল্যান্ডের সঙ্গে জার্মানির রাজন্যবর্গেরও মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
(ix) অন্যান্য পদক্ষেপ –
ক্রমওয়েল গৃহীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলি ছিল- জমি লেনদেনের নিবন্ধীকরণ, স্থানীয় গির্জায় জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলির নিবন্ধীকরণ, পার্লামেন্টের সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সদস্য মনোনয়নে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে অগ্রাধিকার প্রদান প্রভৃতি।
উপরোক্ত পদক্ষেপগুলি গ্রহণের মাধ্যমে টমাস ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডে শক্তিশালী ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন। তাই বলা যায়, ইংল্যান্ডে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ক্রমওয়েলের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
ঐতিহাসিক জিওফ্রে এলটন-এর মতে, টমাস ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ১৫৩০-এর দশকে ইংল্যান্ডের সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে একটি বিপ্লব সাধিত হয়, যা ইংল্যান্ডের ইতিহাসে টিউডর বিপ্লব (Tudor Revolution in Government) নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইংল্যান্ডের সরকারি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকে এই অর্থে বৈপ্লবিক বলা যায় যে, এর দরুন ইংল্যান্ডের সংবিধান এবং সরকার বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। অবশ্য টিউডর বিপ্লব বলতে যা বোঝায়, তা কোনও পুরোনো ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নতুনভাবে তৈরি হয়নি। এলটনের এই বিপ্লব সম্পর্কিত মতটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
4. ধর্মীয় ক্ষেত্রে এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েলের কার্যকলাপের মূল্যায়ন করো।
অথবা, টমাস ক্রমওয়েলের কার্যাবলির মূল্যায়ন করো।
Ans:
ধর্মীয় ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েলের কার্যকলাপ :
ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরির প্রধান সচিব টমাস ক্রমওয়েল ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেন তা হল নিম্নরূপ-
(i) চার্চে পোপের পরিবর্তে রাজার ক্ষমতাবৃদ্ধি –
ইংল্যান্ডের শাসক অষ্টম হেনরির, ক্যাথরিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ও অ্যান বোলিনকে বিবাহের বিষয়ে পোপের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয়। টমাস ক্রমওয়েল এই সমস্যার সমাধানের জন্য, রাজাকে চার্চের সকল ক্ষমতার অধিকারী করে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই তিনি চার্চে রাজার প্রাধান্যকেই গুরুত্ব দেন। টমাস ক্রমওয়েলের সক্রিয়তায় ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে চার্চে পোপের পরিবর্তে রাজাকেই (অষ্টম হেনরি) চার্চের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এইভাবে চার্চগুলিতে রাজার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ii) ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন দান –
ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে সফল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং রাজা অষ্টম হেনরির পূর্বতন মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা কার্ডিনাল উলসির বিরোধিতায় সচেষ্ট হন।
(iii) রিফরমেশন পার্লামেন্ট –
ইংল্যান্ডে স্বাধীন চার্চ প্রতিষ্ঠা এবং রাজার ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ক্রমওয়েল রিফরমেশন পার্লামেন্টের সাহায্যে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন। আইনগুলির মূল উদ্দেশ্যই ছিল ধর্মসংস্কার। যেমন প্রোবেট অ্যান্ড মরচুয়ারি অ্যাক্টে ধর্মীয় আদালতে উইলের প্রতিলিপি সংক্রান্ত অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অ্যাক্ট অফ অ্যানেটসের মাধ্যমে পোপেদের প্রাপ্ত কর থেকে বঞ্চিত করা হয়। পোপের কাছে কেউ যাতে ধর্মীয় কোনও বিষয় অভিযোগ জানাতে না পারে তার জন্য অ্যাক্ট ইন রেসট্রেন্ট অফ অ্যাপিলস নামক আইন প্রণয়ন করা হয়। এ ছাড়াও অ্যাক্ট অফ প্লুরালিটিজ দ্বারা যাজকদের নানান সুযোগসুবিধার উপর বিধিনিষেধ এবং প্রেমুনিয়ার আইনে আইন ভঙ্গকারী যাজকদের ১ লক্ষ পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়।
(iv) অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি পাস –
চার্চ ও পোপতন্ত্রের প্রাধান্য হ্রাস করার জন্য টমাস ক্রমওয়েল যে আইনগুলি পাস করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি (১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ)। এই আইন দ্বারা ইংল্যান্ডের চার্চের উপর রাজার সার্বভৌমত্বকে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া এতদিন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের চার্চের উপর পোপের যে একাধিপত্য ছিল, তা অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসির মাধ্যমে লুপ্ত করা হয়। ফলে চার্চ ও রাষ্ট্র উভয়ের উপর রাজার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
(v) মঠগুলির উচ্ছেদসাধন –
ইংল্যান্ডে রাজার কর্তৃত্বকে সর্বক্ষেত্রে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠায় টমাস ক্রমওয়েল যে নানাবিধ উদ্যোগ নেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মঠব্যবস্থার উচ্ছেদসাধন। ইংল্যান্ডের মঠগুলি ছিল প্রভৃত পরিমাণ ধনসম্পত্তির অধিকারী এবং মঠের জীবনও ছিল কলুষতাপূর্ণ। রাজার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের ছোটো ছোটো মঠগুলি বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেন এবং মঠের সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ দ্বারা তিনি রাজকোশাগারের আয় বৃদ্ধি করেন। এক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েল দুটি আইন পাস করেছিলেন, যথা-
- প্রথম উচ্ছেদ আইন (Suppression of Religious Houses Act, ১৫৩৬ খ্রি.): এর দ্বারা ২০০ পাউন্ড-এর কম বাৎসরিক আয়সম্পন্ন মঠগুলিকে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে ভেঙে দেন। ক্ষুদ্র মঠগুলির উচ্ছেদসাধনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ লিঙ্কনশায়ার, ইয়র্কশায়ার এবং ধীরে ধীরে সমগ্র উত্তর ইংল্যান্ডে এক বিদ্রোহের (পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস) সূচনা হয়। কিন্তু টমাস ক্রমওয়েল কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে যাজকদের রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথগ্রহণে বাধ্য করেন।
- দ্বিতীয় উচ্ছেদ আইন (Suppression of Religious Houses Act, ১৫৩৯ খ্রি.): এর দ্বারা ইংল্যান্ডের অবশিষ্ট বৃহৎ মঠগুলির উচ্ছেদসাধন করে সমস্ত সম্পত্তি রাজার অধিকারে আনা হয়। এইভাবে তিনি ইংল্যান্ডের চার্চতন্ত্রের প্রাধান্যরোধে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
(vi) বাইবেল-এর অনুবাদ –
টমাস ক্রমওয়েল মাইলস কভারডেলকে (Myles Coverdale) ইংরেজি ভাষায় বাইবেল অনুবাদে প্রেরণা দেন। মূলত ক্রমওয়েলের উদ্যোগেই ইংল্যান্ডের ছাপাখানায় পবিত্র বাইবেল-এর ইংরেজি অনুবাদ মুদ্রিত হয়। তাঁর উৎসাহে কভারডেল ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট বাইবেল প্রকাশ করেন, যা ইংল্যান্ডের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েলের কার্যকলাপ :
টমাস ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
(i) পোপ তথা ইটালির সঙ্গে সম্পর্ক –
ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহকে কেন্দ্র করে পোপের সঙ্গে ইংল্যান্ডের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছোয়। এই পরিস্থিতিতে টমাস ক্রমওয়েল রিফরমেশন পার্লামেন্টের আইনবলে ইংল্যান্ডের চার্চকে পোপের প্রভাবমুক্ত করে অষ্টম হেনরির অধীনস্থ করেন। ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপকে যাজক পদে নিযুক্ত করা হয় এবং রোমের পোপকে বার্ষিক ধর্মীয় করপ্রদান বন্ধ করা হয়। এভাবে সুকৌশলে টমাস ক্রমওয়েল ইটালির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
(ii) ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক –
ক্যাথরিনের সঙ্গে অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদের পর স্পেনরাজ পঞ্চম চার্লস ইংল্যান্ডের শত্রুতে পরিণত হন। এই পরিস্থিতিতে টমাস ক্রমওয়েল স্পেনরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরাজের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। টমাস ক্রমওয়েল ফ্রান্সের সঙ্গে বৈদেশিক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন।
(iii) জার্মানির সঙ্গে সম্পর্ক –
টমাস ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্য জার্মানির রাজন্যবর্গের সমর্থনলাভের চেষ্টা করেন। ফলে সাময়িকভাবে হলেও ইংল্যান্ডের সঙ্গে জার্মানির রাজন্যবর্গের মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
মূল্যায়ন :
টমাস ক্রমওয়েল ধর্মীয় ও পররাষ্ট্রনীতি-উভয়ক্ষেত্রেই যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা ইংল্যান্ডের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গভীর পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। ধর্মীয় ক্ষেত্রে মঠগুলির ধ্বংসসাধনের ফলে ইংল্যান্ডে পোপতন্ত্রের ক্ষমতা যেমন বিনষ্ট হয়, তেমনই মঠের বিশাল সম্পদকে রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়। অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বলা যায় যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সুসম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্যে ক্রমওয়েলের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয়েছিল। পার্লামেন্টের আইনের সাহায্যে যে নীতি ও ব্যবস্থা রূপায়ণের জন্য ক্রমওয়েল সচেষ্ট হয়েছিলেন, সেখানে কেউ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারেনি। তাঁর নীতি খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। সামগ্রিকভাবে টমাস ক্রমওয়েলের ধর্মীয় ও পররাষ্ট্রনীতির সাহায্যে ইংল্যান্ডে বিপ্লব সাধিত হয়। তাই বলা যায়, সমকাল ও পরবর্তীকালের ইংল্যান্ডের জাতীয় জীবনে টমাস ক্রমওয়েলের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
5. রোমান রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করো।
অথবা, রোমান রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি আলোচনা করো।
Ans: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে প্রাচীন রোমের অবদান যে খুব চমকপ্রদ, একথা বলা যায় না। গ্রিক পণ্ডিত প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস প্রমুখ রাষ্ট্রপরিচালনার যে তাত্ত্বিক ধ্যানধারণা প্রচার করেছিলেন, রোমে তেমন কিছু ঘটেনি। বলা যেতে পারে, রোমান রাষ্ট্রচিন্তার মূলসূত্রগুলি গ্রিস থেকেই নেওয়া হয়েছে। তবে রোমান পণ্ডিত সিসেরো, সেনেকা এবং গ্রিস থেকে রোমে এসে রাষ্ট্রদর্শন চর্চাকারী পলিবিয়াস-এর লেখায় প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তার কিছু আভাস পাওয়া যায়।
প্রেক্ষাপট :
রোমের ইতিহাস থেকেই এদেশের রাষ্ট্রচিন্তার মূলসূত্রটি অনুসন্ধান করা সম্ভব। প্রাচীন গ্রিসের মতো রোমান জনগণ একজাতি তত্ত্বের দাবি করতেন না। রোমে এটুস্ক্যান, গল, গ্রিক, স্যাবাইন ইত্যাদি নানা জাতির আগমন ও সহাবস্থান ঘটেছে। নানা জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে রোমান জাতির। বলাবাহুল্য, এই বহুমুখী ভাষা, কৃষ্টি, ধর্মের সহাবস্থান ও সংমিশ্রণ রোমান রাষ্ট্রদর্শনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। এর পাশাপাশি ভৌগোলিক পরিবেশ, আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ- এসবই রোমান রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশের প্রেক্ষাপট গঠনে সাহায্য করেছিল।
রোমান রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিক/প্রকৃতি :
(i) ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক: রোমান রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্র ও ব্যক্তি- উভয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং মর্যাদা স্বীকৃতি পেয়েছে। রোমান রাষ্ট্রবিদদের মতে, রাষ্ট্র সমাজের এক স্বাভাবিক ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির অধিকারসমূহের সংরক্ষণই হল রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান কাজ।
(ii) কর্মবাদে বিশ্বাস: রোমানদের রাষ্ট্রদর্শন মূলত কর্মের দর্শন। রোমান জনতা মূলত তত্ত্বকথার পরিবর্তে কর্মশক্তিতেই আস্থাশীল ছিলেন।
(iii) আইনের কর্তৃত্ব: রোমান রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আইন সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান। স্টোয়িক দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রোমানরা আইনকে সুসংগঠিত রূপ দানে প্রয়াসী হন। অবশ্য এই আইনের উৎস ছিল বাস্তব প্রয়োজন। মূলত রাষ্ট্র ও সমাজের সংহতি এবং প্রগতির জন্য এই আইনের মান্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। রোমান আইনের প্রকৃতি ছিল দৃষ্টবাদ। দৃষ্টবাদী আইনের গুরুত্ব এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তাই রোমকে আধুনিক আইনব্যবস্থার সূতিকাগার বলা হয়।
(iv) বাস্তববাদিতা: রোমান রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বাস্তববাদিতা। বাস্তবের কঠোর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় রোমান রাষ্ট্রচিন্তায়। রোমে প্রজাতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার সময় সামাজিক সংকট লক্ষ করা যায়। অভিজাত শ্রেণির (প্যাট্রিসিয়ান) সঙ্গে সাধারণ শ্রেণির (প্লেবিয়ান) মধ্যে বিরোধ সংকট সৃষ্টি করে। এই সংকট থেকে নিষ্পত্তির জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করা হয়। শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্বিন্যাস ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে উভয় শ্রেণির অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
(v) চুক্তির ধারণা: রোমান রাষ্ট্রচিন্তায় চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হলেও রাষ্ট্র চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে সেকথা বলা হয়নি। রোমান রাষ্ট্রচিন্তায় সামাজিক চুক্তির ধারণাকে সমর্থন করা না হলেও সরকারি চুক্তির ধারণা এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। রোমান চিন্তাবিদরা মনে করেন, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁদের মতে, জনসাধারণ চুক্তির দ্বারা সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। তাই এইভাবে চুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণ বিদ্রোহ করতে পারে না, কারণ এর দ্বারা চুক্তি ভঙ্গ হয়।
(vi) মিশ্র শাসনব্যবস্থা: রোমান রাষ্ট্রচিন্তার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে সরকার ও সংবিধান সংক্রান্ত বিষয়েরও উল্লেখ করা যায়। মিশ্র শাসনব্যবস্থার ধারণাটি এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন। পলিবিয়াস মনে করেন যে, সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় শাসন হল রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে মিশ্রণ।
(vii) বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ গঠন: বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ গঠনও ছিল রোমান রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রোমান চিন্তাবিদরা যে আইনতত্ত্ব উপস্থাপিত করেছিলেন তার মূল উৎস ছিল প্রকৃতির যুক্তিবাদিতা ও সাম্যের আদর্শ। স্টোয়িক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় তাঁদের চিন্তাধারায় বিশ্বমানবতা ও বিশ্বজনীনতার আদর্শ পরিলক্ষিত হয় যা ছিল সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ।
6. পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর স্টোয়িক দর্শনকে পরিমার্জিত করে এবং রোমান রাষ্ট্রচিন্তাকে এক নতুন আঙ্গিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যেসকল দার্শনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, পলিবিয়াস (Polybius) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যুগসন্ধিক্ষণের দার্শনিক হিসেবে গ্রিসের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভাঙন এবং রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি।
পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তা :
স্টোয়িক দর্শনের পথিকৃৎ পলিবিয়াস গ্রিসে তাঁর দর্শনচর্চা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে গ্রিস রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত হলে একজন যুদ্ধবন্দি হিসেবে তাঁকে রোমে নিয়ে আসা হয়। রোমে এসেই মূলত পলিবিয়াস রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে তাঁর গবেষণা চালানোর সুযোগ পান।
(i) রাষ্ট্রচিন্তার স্বরূপ: পলিবিয়াস যখন হিস্ট্রি অফ রোম গ্রন্থ রচনা শুরু করেন তখন রোমান প্রজাতন্ত্রের স্বর্ণযুগ। তিনি এই গ্রন্থে রোমান সরকারের পক্ষে কীভাবে আইনকানুন এবং শাসনতন্ত্র প্রয়োগ করে একটি বৃহত্তর সাম্রাজ্য গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়েছে, তারই বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। রোম কীভাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে, এমনকি রোমান রাষ্ট্রশাসনের বিভিন্ন দিক এসকল বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। তাছাড়া রোমের উত্থান ও সাফল্যের ইতিহাস রচনার সঙ্গে সঙ্গে পলিবিয়াস রাষ্ট্রশাসন ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু তাত্ত্বিক আলোচনাও উপস্থাপন করেন।
(ii) স্বাভাবিক আবর্তন তত্ত্ব: পলিবিয়াস স্বাভাবিক আবর্তন তত্ত্ব (Natural Cycle) উপস্থাপিত করে সরকার বা শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন ধরন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি বর্ণনা করেন। এ ছাড়া অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে তিনি বলেন যে, সরকার তিন ধরনের হতে পারে- রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র। প্রতিটি সরকারই ন্যায়নীতির রক্ষক কিংবা অত্যাচারী হতে পারে। এই কারণে সরকারের রূপের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পলিবিয়াস বলেন যে, প্রথম অবস্থায় রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু অধিকাংশ রাজতন্ত্রই শেষপর্যন্ত স্বেচ্ছাচার ও নিপীড়নমূলক রাজনীতি গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে মানুষ সংগঠিত হয় এবং অভিজাততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু অভিজাতদের মধ্যে কেউ কেউ স্বার্থসিদ্ধির জন্য লোভ, ষড়যন্ত্র ও গোষ্ঠীবদ্ধতার শিকার হন। ফলে এই শাসনব্যবস্থাতেও ভাঙন দেখা দেয়। এসময় সাধারণ মানুষ অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হন। অবশেষে জনসাধারণের উদ্যোগে সূচনা ঘটে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। অবশ্য পলিবিয়াস এরূপ আশঙ্কা করেন যে, গণতান্ত্রিক সরকারও যেমন বিপথগামী হতে পারে তেমনই সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার প্রভাবে এই শাসন উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনেও রূপান্তরিত হতে পারে।
(iii) মিশ্র শাসনতন্ত্রের ধারণা: রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থার এহেন পরিবর্তন রোধ করে স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পলিবিয়াস মিশ্র শাসনতন্ত্র (Mixed Rule)-এর প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শনের সমন্বয়ে গঠিত একটি মিশ্র শাসনতন্ত্রই কার্যকরী হতে পারে। এই শাসনতন্ত্রকে রাষ্ট্রের পক্ষে স্থায়িত্ব, শক্তি ও শান্তির প্রতীকরূপে গণ্য করা সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে মিশ্র শাসনব্যবস্থা তথা সরকারের ধারণা তিনি উপস্থাপিত করেছেন সেখানে রাজা থাকবেন শাসনক্ষমতার শীর্ষে, জ্ঞানীগুণী অভিজাতরা হবেন রাজার উপদেষ্টা ও আইনসভা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে। নগররাষ্ট্র স্পার্টায় লাইকারগাস (Lycurgus) স্পার্টানদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আংশিকভাবে এই প্রকার সমন্বয় সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত পলিবিয়াস রোমান প্রজাতান্ত্রিক যুগের শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে, প্রজাতন্ত্রের যুগে কনসাল ছিলেন রাজার মতোই ক্ষমতাশালী। কিন্তু তাঁর স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ ছিল না। সিনেট-এর সদস্যরা ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ- তাঁরা ছিলেন অভিজাততন্ত্রের প্রতীক। অন্যদিকে জনগণের সভা (কমিসিয়া সেঞ্চুরিয়াটা) ছিল গণতন্ত্রের প্রতিভূ। বাস্তবিক ক্ষেত্রে বলা যায় যে কনসাল, সিনেট এবং জনগণের মধ্যে একরকম নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি (The principle of Checks and Balances) প্রচলিত ছিল। বলাবাহুল্য এই ত্রয়ীর শাসনকালে রোম গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করতে পেরেছিল।
(iv) যুক্তিবাদিতা: বস্তুতপক্ষে যুক্তিবাদিতা ছিল পলিবিয়াসের কল্পিত সরকারের অপর বৈশিষ্ট্য। তাঁর মতানুযায়ী, সমকালীন রোমে শ্রেণি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যুক্তির দ্বারা প্রধানত রাষ্ট্র ও সরকারের কাঠামো পরিচালিত হত। তিনি আরও বলেন যে, সরকারি ভারসাম্য নীতির প্রধান লক্ষ্যই হবে সমভাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থের সুরক্ষা করা।
মূল্যায়ন :
পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকদের মতে, বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী আদর্শের একত্রে সংমিশ্রণ করার ক্ষেত্রে তার প্রয়াস বাস্তবসম্মত নয়। তাছাড়া পলিবিয়াসের বিশ্বজনীন আইনের ধারণাও বাস্তবের সঙ্গে খুব একটা সংগতিপূর্ণ নয় বলে অনেকে মনে করেন। এসব সত্ত্বেও বলা যায় পলিবিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (Check and Balance)-এর তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি মনে করেন যে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠী স্বার্থকেন্দ্রিক ঘাতপ্রতিঘাতের (Interaction) মধ্য দিয়ে একটি ভারসাম্য বিশিষ্ট শাসনধারা অনুসরণ করতে পারবে। স্যাবাইন-এর মতে, পলিবিয়াসের মিশ্র শাসনতন্ত্রের ধারণা পরবর্তীকালে ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কু এবং মার্কিন সংবিধান রচয়িতাদের প্রভাবিত করেছিল। গেটেল বলেছেন যে, পলিবিয়াসের এই নিরপেক্ষ ও মোহমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তায় প্রতিফলিত হয়েছে। আবার ডানিং মনে করেন যে, পলিবিয়াসের রাষ্ট্রদর্শন আধুনিক যুগের উদারতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম।
7. সিসেরোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রীয় আইনবিধি সংক্রান্ত সিসেরোর অভিমত আলোচনা করো।
Ans: রোমের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, বাগ্মী এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন মার্কাস টুল্লিয়াস সিসেরো (Marcus Tullius Cicero)। – সুপণ্ডিত সিসেরোর বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকলেও আইন ও রাষ্ট্রনীতিচর্চায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। De Republica (ইংরেজিতে On the Republic) এবং De Legibus (ইংরেজিতে On the Laws) গ্রন্থ দুটি থেকে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার সম্যক পরিচয় মেলে।
সিসেরোর রাষ্ট্রদর্শন :
প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পলিবিয়াস ও স্টোয়িকদের মতবাদ দ্বারা সিসেরোর রাষ্ট্রদর্শন বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। প্লেটোর ন্যায় সিসেরোও তাঁর গ্রন্থ De Republica-তে এক আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি –
সিসেরো বিশ্লেষণ দ্বারা দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র একদিনে গড়ে ওঠেনি, বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। সিসেরোর রাষ্ট্রব্যবস্থার দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল ন্যায়বিচার ও যথার্থ আইনের প্রতি আনুগত্য।
শাসনব্যবস্থার স্বরূপ –
সিসেরোর মতে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র যে-কোনো একটি শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পেতে পারে। অবশ্য এই সকল শাসনপদ্ধতির কোনোটিই এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ বা ত্রুটিমুক্ত নয়।
- (a) রাজতন্ত্র: এই শাসনব্যবস্থায় রাজার একক শাসন কায়েম থাকে। তিনি স্বেচ্ছাচারী হলে সাধারণের সমাজজীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। আবার রাজা সদাচারী, প্রজাহিতৈষী হলেও, রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ থাকে না।
- (b) অভিজাততন্ত্র: অভিজাততন্ত্র হল মুষ্টিমেয় এবং সমাজের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তির শাসন। এক্ষেত্রেও শাসকদের মধ্যে গোষ্ঠীস্বার্থ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ইত্যাদি প্রবল হলে শাসনব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও গতিশীলতা ব্যাহত হয়।
- (c) গণতন্ত্র: উন্নত ও গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হল গণতন্ত্র। এখানে সর্বসাধারণের ইচ্ছা শাসনতন্ত্রে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। তখন গণতন্ত্র একদল উচ্ছৃঙ্খল মানুষের অপশাসনে পরিণত হয়।
মিশ্র সরকার –
সিসেরোর মতে, সব সরকারের ভালো দিক ও খারাপ দিক দুই-ই আছে। সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হল- রাজতন্ত্র, অভিজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ভালো দিকগুলি নিয়ে গঠিত এক মিশ্র শাসনব্যবস্থা। আবার এই শাসনব্যবস্থা যাতে কোনও একদিকে ঝুঁকে না পড়ে সেই জন্য তিনি নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলেছেন।
আইন সংক্রান্ত ধারণা –
De Legibus (On the Laws) গ্রন্থে সিসেরো দুই ধরনের আইনের উল্লেখ করেন, যথা- প্রাকৃতিক আইন (Law of Nature) এবং রাষ্ট্রীয় আইন বা স্বাভাবিক আইন (Law of State)।
- (a) প্রাকৃতিক আইন: সিসেরোর মতে, বস্তুত যে নিয়ম বা আইনের
সাহায্যে ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করেন, তাকে বলা হয় প্রাকৃতিক আইন। রাষ্ট্র-সহ সমস্ত মানুষ এই প্রাকৃতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অপরিবর্তনীয়, অভ্রান্ত ও শাশ্বত।
সিসেরো আরও দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক আইন হল রাষ্ট্রের উৎস। তাই রাষ্ট্র প্রণীত বিভিন্ন আইনকে প্রাকৃতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এর উপরেই রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য নির্ভর করে। প্রাকৃতিক আইনবিরোধী কোনোরকম রাষ্ট্রীয় আইনকে আইন বলা যায় না।
- (b) রাষ্ট্রীয় বা স্বাভাবিক আইন: সিসেরোর মতে, রাষ্ট্রীয় আইন হল মানুষের সৃষ্ট। ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই এই আইনগুলি রচিত হয়। সিসেরোর তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রের শাসক দুধরনের আইনের সাহায্য নিয়েই দেশ শাসন করবেন। আইনের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম আনুগত্য থাকা প্রয়োজন।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা –
সিসেরো তাঁর ডি রিপাবলিকা গ্রন্থে ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে আলোচনায় বলেছেন যে- ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা হল জাতির মেরুদণ্ড। ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক আইনের যথাযথ পালনই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট আইনকেও মানবকল্যাণে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে তবেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
প্রাকৃতিক সাম্যের নীতি –
সিসেরো প্রাকৃতিক সাম্যনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, প্রকৃতি সকল মানুষকেই সমান অধিকার প্রদান করে। সিসেরো সাম্যনীতিকে মানবজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অপরিহার্য শর্ত বলে মনে করেন।
বিশ্বনাগরিকত্ব –
সিসেরোর মতানুসারে, সকল মানুষই সর্বজনীন প্রাকৃতিক আইনের অধীন। সমগ্র বিশ্বকে তিনি একটি রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করেছেন। সিসেরো পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্র নিয়ে এক রাষ্ট্র সমবায় বা কমনওয়েলথ গঠনের আদর্শ তুলে ধরেন। এই রাষ্ট্রের নাগরিকরা বিশ্বনাগরিক হিসেবে সমান সুযোগসুবিধা পাবে এবং প্রত্যেকেই প্রাকৃতিক আইন মেনে চলবে।
আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা –
সিসেরো আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কোনও একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বসমাজের বৃহত্তম পরিসরে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তাঁর মতে, একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদা বিকাশের উপযোগী ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠবে।
নাগরিকদের কর্তব্য –
আদর্শ নাগরিকেরা হবে সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা-সহ বিভিন্ন সদগুণের অধিকারী। তাঁরা অন্যের ক্ষতি ও পরের সম্পত্তি হরণ করবে না, কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করবে এবং জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। তাছাড়া নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল তারা পিতৃভূমি রক্ষার জন্য যুদ্ধ করবে।
জনকল্যাণসাধন –
রাষ্ট্র বিষয়ে সিসেরোর চিন্তা প্রধানত জনগণের মঙ্গলচিন্তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তাঁর মতে, মানুষের মঙ্গলের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনও মানুষের কল্যাণসাধনের জন্যই রচিত হয়। তাই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত।
মূল্যায়ন :
সিসেরোর রাষ্ট্রদর্শন নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, সমকালীন রোমের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিচার করলে সিসেরোর চিন্তায় মৌলিকত্বের ছাপ ছিল খুবই সামান্য। তাছাড়া অনেকে মনে করেন, সিসেরো যে নীতি ও পদ্ধতি রোমে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তার সবকিছু বাস্তবসম্মত ছিল না। উক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা, আদর্শ রাষ্ট্রগঠন ও সাম্যনীতি সম্পর্কে সিসেরোর অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
Class 11th All Semester Question and Answer – একাদশ শ্রেণীর সমস্ত সেমিস্টার প্রশ্নউত্তর
আরোও দেখুন:-
Class 11 All Subjects 1st Semester Question and Answer Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 All Subjects 2nd Semester Question and Answer Click here
Class 11 Suggestion 2025 (Old) – একাদশ শ্রেণীর সাজেশন ২০২৫
আরোও দেখুন:-
Class 11 History Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 English Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 Geography Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 History Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 Political Science Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 Education Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 Philosophy Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 Sociology Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 Sanskrit Suggestion 2025 Click here
আরোও দেখুন:-
Class 11 All Subjects Suggestion 2025 Click here
একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | West Bengal Class 11th History Question and Answer / Suggestion / Notes Book
আরোও দেখুন :-
একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নউত্তর Click Here
FILE INFO : রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer with FREE PDF Download Link
PDF File Name | রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer PDF |
Prepared by | Experienced Teachers |
Price | FREE |
Download Link | Click Here To Download |
Download PDF | Click Here To Download |
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – অধ্যায় থেকে আরোও বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর দেখুন :
Update
[আরও দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন রচনা – Rabindranath Tagore Biography in History]
[আমাদের YouTube চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন Subscribe Now]
Info : রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সাজেশন বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর
Class 11 History Suggestion | West Bengal WBCHSE Class Eleven XI (Class 11th) History Question and Answer Suggestion
” রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর “ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টপিক একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা (West Bengal Class Eleven XI / WB Class 11 / WBCHSE / Class 11 Exam / West Bengal Council of Higher Secondary Education – WB Class 11 Exam / Class 11th / WB Class 11 / Class 11 Pariksha ) এখান থেকে প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী । সে কথা মাথায় রেখে Bhugol Shiksha .com এর পক্ষ থেকে একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষা প্রস্তুতিমূলক সাজেশন এবং বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর ( একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সাজেশন / একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ও উত্তর । Class-11 History Suggestion / Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer / Class 11 History Suggestion / Class-11 Pariksha History Suggestion / History Class 11 Exam Guide / MCQ , Short , Descriptive Type Question and Answer / Class 11 History Suggestion FREE PDF Download) উপস্থাপনের প্রচেষ্টা করা হলাে। ছাত্রছাত্রী, পরীক্ষার্থীদের উপকারে লাগলে, আমাদের প্রয়াস একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষা প্রস্তুতিমূলক সাজেশন এবং বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর (Class 11 History Suggestion / West Bengal Eleven XI Question and Answer, Suggestion / WBCHSE Class 11th History Suggestion / Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer / Class 11 History Suggestion / Class 11 Pariksha Suggestion / Class 11 History Exam Guide / Class 11 History Suggestion 2024, 2025, 2026, 2027, 2028, 2029, 2030 / Class 11 History Suggestion MCQ , Short , Descriptive Type Question and Answer. / Class-11 History Suggestion FREE PDF Download) সফল হবে।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি – Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – SAQ সংক্ষিপ্ত বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণির ইতিহাস
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – SAQ সংক্ষিপ্ত বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি – Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – SAQ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।
একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণির ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – প্রশ্ন উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Question and Answer, Suggestion
একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – | পশ্চিমবঙ্গ একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সহায়ক – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর । Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer, Suggestion | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Notes | West Bengal Class 11th History Question and Answer Suggestion.
একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – MCQ প্রশ্ন উত্তর | WBCHSE Class 11 History Question and Answer, Suggestion
একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – প্রশ্ন উত্তর বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি – । Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion.
WBCHSE Class 11th History Rastrer Prokriti Suggestion | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি –
WBCHSE Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – প্রশ্ন উত্তর বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর । রাষ্ট্রের প্রকৃতি – | Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – প্রশ্ন উত্তর বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর ।
Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestions | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর
Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – সংক্ষিপ্ত, রোচনাধর্মী বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর ।
WB Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – সাজেশন
Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি – সাজেশন । Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর।
West Bengal Class 11 History Suggestion Download WBCHSE Class 11th History short question suggestion . Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion download Class 11th Question Paper History. WB Class 11 History suggestion and important question and answer. Class 11 Suggestion pdf.পশ্চিমবঙ্গ একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার সম্ভাব্য সাজেশন ও শেষ মুহূর্তের বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর ডাউনলোড। একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার জন্য সমস্ত রকম গুরুত্বপূর্ণ বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর।
Get the Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer by Bhugol Shiksha .com
Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer prepared by expert subject teachers. WB Class 11 History Suggestion with 100% Common in the Examination .
Class Eleven XI History Rastrer Prokriti Suggestion | West Bengal Council of Higher Secondary Education (WBCHSE) Class 11 Exam
Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer, Suggestion Download PDF: West Bengal Council of Higher Secondary Education (WBCHSE) Class 11 Eleven XI History Suggestion is provided here. Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion Questions Answers PDF Download Link in Free here.
রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer
অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই ” রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer ” পােস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই Bhugol Shiksha ওয়েবসাইটের পাশে থাকো যেকোনো প্ৰশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলাে করো এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তোলো , ধন্যবাদ।